Main Menu

হাজার কোটি টাকার প্রকল্প ভেস্তে যাওয়ার শংকা, ছাতক

১৯৩৭ সালে যাত্রা শুরু করা বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ কর্পোরেশন (বিসিআইসি)’র নিয়ন্ত্রণাধীন দেশের একমাত্র পূর্ণাঙ্গ সিমেন্ট কারখানা ছাতক সিমেন্ট কম্পানির নতুন প্রকল্প বাস্তবায়ন ও স্থায়িত্ব নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে।

ছাতক সিমেন্ট কারখানার আধুনিকায়নে ব্যালেন্সিং মর্ডানাইজেশন রেনোভেশন এন্ড এক্সপেনশন (বিএমআরই) প্রকল্পের প্রায় হাজার কোটি টাকা হরিলুটের অভিযোগ উঠেছে।

এসব অভিযোগ এবং বিগত সময়ে কালের কণ্ঠে কয়েকটি সংবাদ প্রকাশের প্রেক্ষিতে বিসিআইসি ও দুর্নীতী দমন কমিশনের উচ্চ পর্যায় থেকে বেশ কয়েকটি তদন্ত চলমান রয়েছে।

জানা যায়, এই কারখানায় উৎপাদিত ডায়মন্ড ব্র্যান্ডের সিমেন্টের চাহিদা দেশের বাইরেও রয়েছে। অতীতে কারখানা আধুনিকায়নের উদ্যোগ না নিয়ে উল্টো কারখানাটি বেসরকারিকরণের প্রচেষ্টা চালানো হয়। পরবর্তীতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, শিল্প মন্ত্রণালয় ও স্থানীয় সংসদ সদস্য মুহিবুর রহমান মানিকের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ওয়েট প্রসেস থেকে কারখানাটিকে ড্রাই প্রসেস প্রকল্পে রূপান্তর করতে ২০১৬ সালে ৮ মার্চ একনেকে আধুনিকায়ন ড্রাই প্রসেস প্রকল্পের অনুমোদন হয়।

চীনের নানজিং সি-হোপ ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ৮৯২ কোটি টাকা ব্যয়ে নতুন প্রকল্পের কাজ শুরু করেছে।

দুদকের মহাপরিচালক বরাবর ছাতকের আব্দুর রশীদ নামের এক ব্যক্তির অভিযোগ থেকে জানা যায়, নানজিং সি-হোপ মূল কাজটি পেলেও এর মূল হোতা হিসেবে রয়েছেন বিসিআইসির বিভিন্ন প্রকল্পে কালো তালিকায় থাকা ড. নাজির মো. খান। যিনি চায়নিজ কম্পানির এ দেশিয় কান্ট্রি ডিরেক্টর হিসাবে দায়িত্বে রয়েছেন।

পূর্বে ঘোড়শাল সার কারখানায় কন্ট্রোল বাল্ব ক্রয়ের জন্য একটি আন্তর্জাতিক টেন্ডারে অংশগ্রহণ করেন নাজির মো. খান। টেন্ডারে তিনি সর্বনিম্ন দরদাতা হিসাবে ক্রয়াদেশ পান। বাল্ব সাপ্লাইয়ের কয়েকদিন পরেই এগুলো সিজ হয়ে যায় এবং কারখানার উৎপাদনে বিঘ্ন ঘটায়। ওই সময় তার ফার্ম এম এম সার্ভিসকে কালো তালিকাভুক্ত করে বিসিআইসি।

একই রকম অভিযোগ রয়েছে চট্রগ্রাম কেমিক্যাল কমপ্লেক্সের বিএমআরই প্রকল্পের কাজ সম্পন্ন না করে ৮০ কোটি টাকা বিল উত্তোলন করে চায়নিজ কম্পানি উহান সাইন্স এন্ড টেকনোলজিকে পালিয়ে যেতে সাহায্য করেছেন তাদের তৎকালীন দেশিয় এজেন্ট নাজির মো. খান। পরবর্তীতে বন্ধই হয়ে যায় প্রতিষ্ঠানটি।

একইভাবে ছাতক সিমেন্ট কারখানার বিএমআরই প্রকল্পের আওতায় এক্সেভেটর, এয়ার কম্প্রেশার, ড্রাম ট্রাক, ফ্রক লিফটার, লকোমেটিভ ইঞ্জিন, হুইল লোডার ক্রয়ের তিনটি আন্তর্জাতিক টেন্ডারে অংশগ্রহণ করে সেই নাজির মো. খানের আরো দুইটি প্রতিষ্ঠান ডিজিটাল মেশিনারিজ ও সেকনিক বাংলাদেশ। তিনটি টেন্ডারেই তার প্রতিষ্ঠান সর্বনিম্ন দরদাতা নির্বাচিত হয়। নিম্নমানের মেশিনারিজ সরবরাহ করেও কর্তৃপক্ষকে ম্যানেজ করে এগুলোর মান যাচাইয়ে পার পেয়ে যান তিনি। পরবর্তীতে এক বছরের মাথায় এগুলোর কার্যকারিতা নষ্ট হয়ে যায় এবং তিনটি টেন্ডারের সঙ্গে ১ কিলোমিটার রেললাইন নির্মাণের কথা থাকলেও এগুলো না করেই বিল নিয়ে চলে যায় তার প্রতিষ্ঠান।

চায়নিজ কম্পানির কাছ থেকে নির্দিষ্ট একটা অংক ব্যয়ে নতুন প্রকল্পের সবগুলো কাজ করার একটা চুক্তি করেন নাজির মো. খান। এতে চায়নিজ কম্পানিকে মোটা অংকের লাভ দেখান তিনি। পরে কমিশন নিয়ে অনভিজ্ঞ কয়েকটি দেশিয় কম্পানির কাছে সাব কন্ট্রাক্ট দেন নাজির মো. খান। ঠিকাদাররা নিম্নমানের মালামাল দিয়ে কাজ করে নিয়মিত বিল তুলে নিচ্ছেন। যেমনটি হয়েছিল চট্টগ্রাম কেমিক্যাল কমপ্লেক্সের ক্ষেত্রে।

ছাতক সিমেন্ট কারখানার বিএমআরই প্রকল্পের বিভিন্ন যন্ত্রপাতি ক্রয়ে ইউরোপীয়ান, আমেরিকান ও জাপানিজ স্ট্যান্ডার্ড অনুসরণ করার কথা থাকলে প্রকল্পের পরিচালক ও কারখানার ব্যাবস্থাপনা পরিচালক এফ এম বারী, বিসিআইসির পরিচালক লুতফুর রহমানকে ম্যানেজ করে নিম্নমানের চায়নিজ কম্পানির মালামাল সরবরাহ করছে।

ইতিমধ্যেই একটি কিলন এর মূল্য ধরা হয়েছে ৭০ কোটি টাকা। প্রকৃতপক্ষে চায়নিজ এ কিলনটির মূল্য ২০ কোটি টাকা। এদিকে কার্যাদেশ অনুযায়ী ১৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে ভার্টিক্যাল বয়লার আনার কথা থাকলেও মাত্র ৬ কোটি টাকা মূল্যের কোনো ধরনের ড্রয়িং এপ্রুভাল ছাড়াই একটি হরিজেন্টাল বয়লার নিয়ে আসা হয়েছে।

এছাড়া প্রজেক্টের সব কাজ দুবাই থেকে আমদানি করা উন্নতমানের পাথর ব্যবহার করার নির্দেশনা ছিল। কিন্তু ইতিমধ্যেই সাড়ে ১০ হাজার টন পাথর ব্যবহার করা হয়েছে। যার মধ্যে মাত্র ২৬ শ টন দুবাই থেকে আমদানি করা। বাকিগুলো চুনা পাথর। নিম্নমানের চুনাপাথর দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ পাওয়ার প্লান্ট কিলনের কাজ করা হয়েছে। ফলে প্লান্টের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেলে যেকোনো সময় চুনা পাথর গলে কম্পানির বড় ধরনের ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

এদিকে ছাতক সিমেন্ট কারখানার নতুন প্রকল্প তদারকি করার জন্য ৬ কোটি টাকা ব্যয়ে বিদেশি পরামর্শক নিয়োগ করা হয়। পরামর্শকরা প্রকল্প পরিদর্শন না করেই নিয়মিতই বিল তুলে নিচ্ছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে।

এসব কাজ নিয়ে শংকা প্রকাশ করেছেন ছাতক সিমেন্ট কারখানার সিবিএ সাধারণ সম্পাদক আব্দুল কুদ্দুস। তিনি জানান, স্থানীয়ভাবে কাজ বুঝে নেওয়ার জন্য কোনো কমিটি করা হয়নি। যার কারণে তারা ইচ্ছেমত কাজ করছে।

আব্দুল কুদ্দুস জানান, দেশে এর আগেও কয়েকটি কম্পানি আধুনিকায়নের পর কিছু দুর্নীতিবাজদের কারণে দুই এক বছর পরেই বিকল হয়ে গেছে। কাজেই ছাতক সিমেন্ট কারখানা আমাদের রাষ্ট্রীয় সম্পদ এবং হাজারো শ্রমিকের বেঁচে থাকার সম্বল। যেকোনো উপায়ে এটাকে রক্ষা করতে হবে।

এ ব্যাপারে প্রকল্পের পরিচালক ও কারখানার ব্যবস্থাপনা পরিচালক এফ এম বারী জানান, কিছু অভিযোগ তিনি শুনেছেন। কয়েকটির তদন্ত চলছে। লাইম স্টোন দিয়ে কাজ করানো সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে তিনি বিষয়টি এড়িয়ে যান।