Main Menu

হাজী সেলিম : পানপতি থেকে শিল্পপতি

এক সময়ে ছিলেন পানবিক্রেতা। এখন তিনি দেশের শীর্ষ ধনীদের একজন। বিভিন্ন সময়ে ক্ষমতাসীনদের আশ্রয়ে-প্রশ্রয়কে কাজে লাগিয়ে পুরান ঢাকার সোয়ারীঘাটের পান দোকানের ব্যবসায়ী থেকে হাজী মোহাম্মদ সেলিম হয়ে উঠেছেন বড় কনগ্লোমারেট মদিনা গ্রুপের মালিক।

ঢাকা-৭ আসনের এমপি হাজী সেলিমের ব্যবসায়িক উত্থানের গল্পটিকে বলা চলে বাংলাদেশে রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা ও পেশিশক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে সমৃদ্ধি অর্জনের কেস স্টাডি হিসেবে। গত তিন দশকে দেশের বড় দুই রাজনৈতিক দলেরই পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছেন তিনি।

স্বাধীনতার আগে হাজী সেলিমের বাবা চান মিয়া ছিলেন সোয়ারীঘাটের পানবিক্রেতা। পিতার সঙ্গে পান বিক্রির মধ্য দিয়ে ব্যবসার জগতে পা রাখেন হাজী সেলিম। স্বাধীনতার পরও পান বিক্রি করেই সংসার চলত পরিবারটির। একপর্যায়ে কোমলপানীয় সেভেন আপের এজেন্সি খুলে বসেন তারা। ওই এজেন্সির আড়ালে নকল কোমলপানীয় বিক্রির অভিযোগ ছিল তাদের বিরুদ্ধে। সে সময় মোহাম্মদ সেলিম, তার বাবা চান মিয়া ও বড় ভাই কায়েস মিয়াকে পুলিশ আটকও করেছিল।

জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর ১৯৭৮-৭৯ সালের দিকে মদিনা ট্রেডিং করপোরেশন নামে সিমেন্টের ব্যবসায় নামেন মোহাম্মদ সেলিম। শুরুর দিকে বাদামতলী থেকে জমাটবাঁধা সিমেন্ট এনে তা ক্র্যাশ করে বিক্রি করা হতো। একপর্যায়ে নিজেই রাজধানীর কামরাঙ্গীরচরে সিমেন্ট কারখানা খুলে বসেন। কিন্তু সে সময়ে সিমেন্টের সঙ্গে বালি ও মাটি মিশিয়ে বাজারজাত করার অভিযোগ ওঠে তার বিরুদ্ধে। বিষয়টি নিয়ে তত্কালীন গণমাধ্যমগুলোয় বেশ লেখালেখিও হয়েছিল।

একপর্যায়ে বাদামতলী এলাকায় ফলের ব্যবসা শুরু করেন হাজী সেলিম। পরে বাদামতলী, ওয়াইজঘাট ও সদরঘাট এলাকার নিয়ন্ত্রণ হাতে নেন তিনি।

নব্বইয়ের দশকে বিএনপি নেতা মীর শওকতের হাত ধরে রাজনীতিতে উত্থান হয় হাজী সেলিমের। ১৯৯৪ সালে তিনি ঢাকা সিটি করপোরেশনের ৬৫ ও ৬৬ নম্বর ওয়ার্ডে গরুর গাড়ি মার্কা নিয়ে কমিশনার নির্বাচিত হন। ১৯৯৬ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেয়ার জন্য বিএনপির মনোনয়ন চেয়েছিলেন হাজী সেলিম। কিন্তু সে ইচ্ছাপূরণ না হওয়ায় আওয়ামী লীগে যোগ দেন তিনি। মনোনয়নও পেয়ে যান। লালবাগ, হাজারীবাগ ও কামরাঙ্গীরচর থানা নিয়ে গঠিত নির্বাচনী এলাকায় বিপুল ভোটে জয়লাভ করেন হাজী সেলিম। এরপর ক্ষমতার ছত্রচ্ছায়া ফুলেফেঁপে উঠতে থাকে তার ব্যবসা ও সম্পত্তির পরিমাণ। তার প্রতিষ্ঠিত মদিনা গ্রুপের ওয়েবসাইটে দেয়া তথ্য অনুযায়ী, ১৯৯৯ সালের মধ্যেই গ্রুপের প্রতিষ্ঠানগুলোর সম্মিলিত বার্ষিক টার্নওভার ৬০০ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়। পরের বছরগুলোয় এ সংখ্যা ক্রমেই বেড়েছে।

এমপি নির্বাচিত হওয়ার পর জমি ও বাড়ি দখলের নেশা পেয়ে বসেছিল হাজী সেলিমকে। স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, ওই সময় হাজী সেলিম নিজ নিয়ন্ত্রণাধীন পাড়া-মহল্লাগুলোয় পঞ্চায়েত প্রথা চালু করেন। ওই সময় অনেকেই তার কাছে বিভিন্ন বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য আসত। এর মধ্যে জমি বা বাড়িসংক্রান্ত বিরোধ নিষ্পত্তিতেও তার সহযোগিতা চাইতে আসতেন স্থানীয়রা। কিন্তু এসব বিরোধ নিষ্পত্তির বদলে হাজী সেলিম নামমাত্র মূল্যে ওই জমির কাগজপত্র কিনে নিতেন। জোরপূর্বক উচ্ছেদের জন্য বিচার শেষে তিনি ঘরে বা দোকানে জোরপূর্বক তালা ঝুলিয়ে দিতেন। এজন্য এলাকায় ‘তালা হাজী’ নামেও খেতাব পেয়েছিলেন তিনি।

 

অনুসন্ধানে জানা যায়, বুড়িগঙ্গার তীরে চাঁদনীঘাটে ওয়াসার পানির পাম্পের জমি দখল করে সেখানে পেট্রলপাম্প তৈরি করেন হাজী সেলিম। এ কাজে তাকে সহায়তা করেন কামালবাগের জমির কাগজপত্র জালিয়াতির হোতা হিসেবে পরিচিত হাফেজ কামাল। এছাড়া সোয়ারীঘাটে নদীতীর দখল করে সেখানে গড়ে তোলেন চাঁদ সরদার কোল্ড স্টোরেজ। এরপর নবাববাড়ী এলাকায় জগন্নাথ কলেজের ছাত্রাবাস দখল করে সেখানে গুলশান আরা প্লাজা নামে বিশাল ভবন নির্মাণ করেন। আরমানিটোলা এলাকায় এক বৃদ্ধার সম্পত্তি দখল করে নির্মাণ করেন এমটিসি টাওয়ার। নলগোলায় ভাওয়াল রাজার সম্পত্তি দখল করে বিশাল ভবন নির্মাণ বরেন।

শুধু তা-ই নয়, হাজী সেলিম চকবাজারের ফ্রেন্ডশিপ মার্কেট ও জেলখানার পাশে ৫০-৬০ বছরের পুরনো ব্যবসায়ীদের জোরপূর্বক উচ্ছেদ করে সেখানে মদিনা আশিক টাওয়ার ও হাজী সেলিম টাওয়ার নামে দুটি বহুতল ভবন ও মার্কেট নির্মাণ করেন। মার্কেট নির্মাণের সময় ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের নতুন দোকান দেয়ার কথা ছিল তার। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কাউকেই কোনো দোকান দেননি তিনি। এ কারণে দুই ব্যবসায়ী আত্মহত্যাও করেছেন বলে জানা গিয়েছে।

এভাবেই হাজী সেলিম রাজধানীর পুরান ঢাকার বাদামতলী, নবাববাড়ী, আরমানিটোলা, মিটফোর্ড রোড, নবাবপুর রোড, ইমামগঞ্জ, ইসলামপুর, লালবাগ, কামরাঙ্গীরচর, হাজারীবাগ, নারায়ণগঞ্জের পাগলা, ফতুল্লা এলাকায় জমিজমার মালিক হন। এছাড়া একসময়ে খুলনার কুখ্যাত এরশাদ শিকদারের সঙ্গেও ব্যবসা করেছেন হাজী সেলিম।

২০০১ সালে বিএনপির নাসিরউদ্দিন আহম্মেদ পিন্টুর কাছে স্বল্প ভোটের ব্যবধানে হেরে যান হাজী সেলিম। বিএনপির ওই মেয়াদ শেষ হওয়ার পর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে বিদেশে গাঢাকা দেন তিনি। পরের নির্বাচনে আর আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাননি হাজী সেলিম। ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ থেকে তার জায়গায় মনোনয়ন পান বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ) নেতা ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন। ক্ষুব্ধ হাজী সেলিম স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে অংশ নিয়ে জয়লাভ করেন। ২০১৪ সালেও আওয়ামী লীগের মনোনয়ন না পেয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করেন হাজী সেলিম। ২০১৫ সালের সিটি করপোরেশন নির্বাচনেও আওয়ামী লীগের হয়ে মেয়র পদে প্রার্থিতা করতে চেয়েছিলেন তিনি। ২০১৬ সালের মাঝামাঝি ব্রেইন স্ট্রোকের কারণে বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেন তিনি। ২০১৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পান তিনি। মনোনয়ন পাওয়ার পর আবার একটু একটু করে কথা বলতে শুরু করেন। নির্বাচনে জয়লাভ করে আগের মতোই ক্ষমতার প্রদর্শন ও দখল কার্যক্রম চালিয়ে যেতে থাকেন তিনি ও তার পরিবারের সদস্যরা।

ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে প্রচুর বিরোধপূর্ণ ও সরকারি জায়গাজমি বা নদীতীর দখল করেই ক্ষান্ত হননি হাজী সেলিম। স্থানীয়রা বলছেন, যেখানেই চোখ পড়েছে হাজী সেলিমের, সেটাই দখল করে নিয়েছেন তিনি। তার হাত থেকে রেহাই পায়নি প্রত্নতাত্ত্বিক গুরুত্বসম্পন্ন নিদর্শনও। হাইকোর্টের নিষেধাজ্ঞার তোয়াক্কা না করে গত বছরও ঢাকার প্রথম বাণিজ্যিক ভবন হিসেবে পরিচিত চকবাজারের শতবর্ষেরও বেশি পুরনো জাহাজবাড়ি গুঁড়িয়ে দিয়েছেন হাজী সেলিম।

ক্ষমতাধর হওয়ার কারণেই হাজী সেলিম ও তার পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে কেউ থানায় অভিযোগ করতে চায় না। এ বিষয়ে জানতে চাইলে চকবাজার থানার ওসি মওদুত হাওলাদার বলেন, হাজী সেলিম বা তার পরিবারের কোনো সদস্যের বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত কোনো ধরনের অভিযোগ নিয়ে কেউ থানায় আসেননি। এলে অবশ্যই তদন্তসাপেক্ষে ব্যবস্থা নেয়া হতো। অপরাধ করলে সে যে-ই হোক, তাকে ছাড় দেয়ার সুযোগ নেই।

এভাবেই রাজনৈতিক ক্ষমতা ও পেশিশক্তিকে কাজে লাগিয়ে নিজের সম্পদ বাড়িয়ে তুলেছেন তিনি। জানা গিয়েছে, রাজধানী ছাড়াও দেশের বিভিন্ন জেলায় নামে-বেনামে হাজী সেলিম ও তার পরিবারের সদস্যদের নামে অসংখ্য বাড়ি ও ফ্ল্যাট রয়েছে। এছাড়া পায়রা বন্দরসংলগ্ন এলাকায় প্রচুর ভূসম্পত্তি কিনেছেন তিনি। হাজী সেলিমের পরিবারের এসব অবৈধ সম্পদের উৎস খতিয়ে দেখা হবে বলে জানিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এরই মধ্যে ওই পরিবারের অবৈধ সম্পদের তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ শুরু হয়েছে বলে জানিয়েছেন দুদক কমিশনার (অনুসন্ধান) মো. মোজাম্মেল হক খান। গতকাল তিনি জানান, সংসদ সদস্য হাজী সেলিম ও তার ছেলে ইরফান সেলিমের অবৈধ সম্পদের তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা হচ্ছে। এসব যদি দুদক আইনে তফসিলভুক্ত হয় তাহলে তা নিয়ে অনুসন্ধান করা হবে।

এছাড়া দখলি সম্পত্তিগুলো দুদক আইনের আওতাভুক্ত হলে সে বিষয়ে ব্যবস্থা নেয়া হবে বলেও জানিয়েছেন তিনি।

ব্যক্তিগত সম্পদের পাশাপাশি এ সময়ের মধ্যে নিজের ব্যবসাকেও সম্প্রসারণ করেছেন তিনি। তার মালিকানাধীন মদিনা গ্রুপের অধীনে রয়েছে মদিনা ট্রেডিং করপোরেশন প্রাইভেট লিমিটেড, মদিনা সিমেন্ট ইন্ডাস্ট্রি লিমিটেড, মদিনা পলি ফাইবার লিমিটেড, মদিনা সিমেন্ট মিলস লিমিটেড, মদিনা মেরিটাইম লিমিটেড, মদিনা কিচেন সিংক, মদিনা ডেভেলপমেন্ট লিমিটেড, মদিনা পলিমার ইন্ডাস্ট্রি লিমিটেড, মদিনা লজিস্টিকস অ্যান্ড শিপিং লিমিটেড, মদিনা ফিলিং সার্ভিসেস লিমিটেড, মদিনা পাম্প অ্যান্ড ফাউন্ড্রি, মদিনা হিমাগার, মদিনা ফ্রুটস লিমিটেড, ফ্লিট ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড, বিছমিল্লাহ নেভিগেশন, এমএমআর (বাংলাদেশ), চাঁদ সরদার কোল্ড স্টোরেজ, টাইগার সিমেন্ট ইত্যাদিসহ মোট ১৬টি প্রতিষ্ঠান।