Main Menu

মাউন্ট এভারেস্ট জয়ী মুসা ইব্রাহীম

হঠাৎ এসে চমকে দিলেন এভারেস্ট জয়ী মুসা ইব্রাহীম

২৭ ফেব্রুয়ারী ২০২২ রাত দশটায় মাত্র বাসায় এসে কাপড় পরিবর্তন করে বসেছি। সিলেট সিটি কর্পোরেশনের ৫ নাম্বার ওয়ার্ডের কাউন্সিলর বন্ধুবরেষু রেজওয়ান আহমদ ফোন দিয়ে জানালেন তিনি বাসায় আসছেন। তিনি আসলেন এবং সাথে দুজন মেহমান। পরিচয় দিলেন, ‘তিনি মুসা ইব্রাহীম, আমার বন্ধু।’ আমি তাঁদের সাথে হাত মিলিয়ে বসতে বললাম। গল্প চলছে। জানতে চাইলাম; বাড়ি কোথায়?  তিনি বললেন, উত্তরবঙ্গের লালমনিরহাটে। এবিষয়ে আর কোন প্রশ্ন করিনি। রেজওয়ান আমার কাছে জানতে চাইলেন, মেহমানকে কি চিনতে পেরেছো? আমি বললাম; না। উত্তর দিলেন; তিনি বাংলাদেশের প্রথম মাউন্ট এভারেস্ট জয়ী মুসা ইব্রাহীম। আমি কিছুটা লজ্জিত হলাম, এত বিখ্যাত একজন মানুষকে আমি চিনতে পারলাম না এবং সামনাসামনি বলে দিলাম, চিনিনা। অবশ্য তিনি যখন মাউন্ট এভারেস্ট জয়ী হয়েছিলেন এবং যখন তাঁকে নিয়ে মিডিয়ায় বিতর্ক চলছিলো তখন বেশ পড়েছি। কিন্তু বুঝতে পারিনি তিনি যে একেবারে আমার বাসায় আমাকে দেখতে চলে আসবেন।

আমি চা আনতে ভেতরে যেতেই আমার ছেলে মুজাদ্দিদ বললো, বাবা তিনি কি মাউন্ট এভারেস্ট জয়ী মুসা ইব্রাহীম। আমি বললাম, হ্যাঁ। ফিরে এসে লজ্জা ঢাকতে মুসা ইব্রাহীমকে বললাম, মাফ করবেন আপনার মতো ব্যক্তিকে চিনতে পারিনি বলে। তবে আমার ছেলে সত্যি চিনতে পেরেছে। তিনি একটু মুচকি হেসে বললেন, আপনি যে বিষয় নিয়ে থাকেন সে বিষয়েও তো আমি অনেক কিছু জানি না। সববিষয়ে সবাইকে সবকিছু জানা সম্ভব নয়। আমার স্ত্রী তাঁর স্বভাবজাত নিয়মে সিঙারা ও কফি পঠিয়ে দিলেন। কফি আর সিঙারা খেতে খেতে জানতে চাইলাম; আপনি কোন বছর গিয়েছিলেন হিমালয় পাহাড়ের চূড়ায়? তিনি বলেন; ২৩ মে ২০১০ খ্রিস্টাব্দে। সকাল ৫টা ৫ মিনিটে এভারেস্ট শৃঙ্গ জয় করি এবং ৫টা ১৬ মিনিটে সেখানে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করি।

হিমালয় পর্বতের চূড়ায় ১৯৫৩ খ্রিস্টাব্দে প্রথম মানুষের পায়ের চিহ্ন স্পর্শ করলেও বাংলাদেশ যেতে পেরেছে ২০১০ খ্রিস্টাব্দে, তাতেও কম কি? আমরা তো স্বাধীনই হলাম ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে। ধন্যবাদ মুসা ইব্রাহীমকে তিনি যে বাংলাদেশের পতাকা হিমালয়ের চূড়ায় উড়িয়েছেন। আমি তাঁর কাছে জানতে চাইলাম; আপনি কোনদিক থেকে হিমালয়ে আরোহণ শুরু করেছিলেন? তিনি বলেন; চায়নার দিকে তিব্বত থেকে। নেপালের ডাংরির দিক থেকেও আরোহন করা যায়, তবে খরচ বেশি।

জানতে চাইলাম; কত ফুট উপরে ছিলো হিমালয়ের চূড়া?

তিনি বলেন; ২৯ হাজার ৩৫ ফুট উচ্চতায় হিমালয়ের সর্বোচ্চ চূড়া।

পর্বত আরোহণে ঝুঁকি বিষয়ে জানতে চাইলে মুসা বলেন; অনেক ঝুঁকি রয়েছে। ২০১৭ খ্রিস্টাব্দের ১৩ জুন তিনি এবং দুজন ভারতীয় পর্বতারোহী ইন্দোনেশিয়ার পাপুয়া প্রদেশে     কার্স্টেনজ পিরামিড পর্বত চূড়া জয় করে নামার পথে বেজ ক্যাম্পে আটকা পড়ে যান। পরে হেলিকপ্টার তাদেরকে উদ্ধার করে ইন্দোনেশিয়ার টিমিকা বিমানবন্দরে নিয়ে যায়।

জানতে চাইলাম; ২৯ হাজার ৩৫ ফুট উচ্চতায় পৌঁছতে কতদিন লেগেছে?

বললেন; ১৭ হাজার ফুট থেকে ২৯ হাজার ফুট পর্যন্ত  পৌঁছতে চল্লিশ দিন সময় লেগেছে।

আমি : এই চল্লিশ দিন কীভাবে খাওয়া-দাওয়া করলেন।

মুসা ইব্রাহীম : ২১ হাজার ফুট পর্যন্ত আমাদের অভিযানের আয়োজনকারি সংস্থা ‘ক্লাইমিং দার্জিলিং’ খাওয়া-দাওয়ার আয়োজন করে। এতটুকু পর্যন্ত তারা গ্যাস সিলিন্ডর নিয়ে পৌঁছে যায় এবং আমাদের ইচ্ছে মতো খাদ্য পাক করে দেয়। তারা সাধারণত ইউরোপিয়ান খাদ্য তৈরি করতো। এটা মূলত তাদের ব্যবসা। পূর্ণাঙ্গ ক্লাবটাই হলো তাদের ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান। প্রথমদিকে ইউরোপিয়ান খাদ্য ভালো লাগলেও দু-তিনদিন পর আর ভালো লাগে না। এরপর প্রত্যেকে নিজের সাথে হালকা বিস্কুট এবং চকলেট রেখেছি। ছোট গ্যাসের চূলাও ছিলো। আমরা চূলায় আগুন জ¦ালিয়ে চা তৈরি করতাম। পানির ব্যবস্থা করতাম বরফ গলিয়ে। বেশ প্রতিকূলতার মোকাবেলাও করতে হয়েছে। বাতাসের পরিমাণ অনুযায়ি ঠান্ডা বৃদ্ধি পেতো।

আমি : শীতের মোকাবেলা কীভাবে করতেন?

মুসা ইব্রাহীম : অভিযান শুরুর আগে আয়োজনকারী সংস্থা আমাদেরকে দোকানে নিয়ে যায় এবং অভিযানকালে যতকিছুর প্রয়োজন সবকিছু খরিদ করায়। একটা জ্যাকেট খরিদ করি মাথা থেকে পা পর্যন্ত। এই জ্যাকেট মূলত শীত এবং গরমের তাপমাত্রাকে নিয়ন্ত্রণ করে। বাতাস প্রবেশের কোন সুযোগ নেই। পায়ে জুতা ছিলো। এই জুতা হিমালয়ের উপযোগি করে তৈরী করা হয়েছে। নীচে ক্লিপ লাগানো ছিলো যাতে পা পিছলে না যায়। এই জুতার ভেতরে বিভিন্ন রকমের ব্যবস্থা রয়েছে শীত আটকানোর জন্য। একটা গামবুটও ছিলো।

আমি : মোট কত টাকা খরচ হয়েছে?

মুসা ইব্রাহীম : আমার খরচ হয়েছে প্রায় চল্লিশ লাখ টাকা। কারো কারো আরও কমবেশ হয়।

আমি : চূড়ায় কতক্ষণ ছিলেন?

মুসা ইব্রাহীম : আধঘন্টা।

আমি : সেখানে শীত কী রকম?

মুসা ইব্রাহীম : সেখানে পৌঁছার পর আমার চোখের ভেতরের পানি বরফ হয়ে যায় এবং সবকিছু ঘোলা দেখতে থাকি। আমি তখন আয়োজককে জিজ্ঞেস করলাম; এখন কি করবো? তিনি বললেন; চশমা লাগাতে। আমি চশমা লাগানোর পর বেশ সময় যায় ঘোলা পরিস্কার হতে।

আমি : সেখানে পৌঁছে অনুভূতি কি ছিলো?

মুসা হাসেন এবং বলেন; অনুভূতি ছিলো আল্লাহ যদি বাঁচিয়ে আবার নীচে ফেরার তৌফিক দেন, তাতেই ভালো।

মুসা ইব্রাহিমের জন্ম ১৯৭৯ খ্রিস্টাব্দে। তিনি পর্বতারোহন ক্লাব ‘নর্থ আলপাইন ক্লাব বাংলাদেশ’-এর মহাসচিব এবং ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক হিসেবে কর্মরত আছেন। এর আগে তিনি বাংলাদেশী বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল টুয়েন্টিফোরে সংবাদদাতা এবং বাংলাদেশী ইংরেজি দৈনিক দ্য ডেইলি স্টারের সহকারী সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। পর্বত আরোহণ ও অ্যাডভেঞ্চার বিষয়ক নানা আয়েজনে তরুণ-তরুণীদের অংশগ্রহণ বাড়াতে তিনি ২০১১ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠা করেন ‘এভারেস্ট একাডেমী’। এছাড়া তিনি বিভিন্ন স্থানে মেরাতন (দৌঁড়) আয়োজনেও সহযোগি হয়ে থাকেন।

রাত সাড়ে এগারোটার দিকে তারা বিদায় চাইলে বাসায় আসার জন্য ধন্যবাদ দিয়ে বিদায় জানাই।