Main Menu

পুলিশকে আনতে হবে সিস্টেমের অধীনে

সাব-ইন্সেপেক্টর আকবরকে অবশেষে কব্জা করার খবরটিতে আনন্দে ফেটে পড়েনি এমন লোক কমই আছে। একইসঙ্গে তারা নিশ্চয়ই পুলিশকেও বাহবা দিচ্ছেন। বলা বাহুল্য, এ অসাধ্য সাধনের জন্য পুলিশ নিশ্চিতভাবে সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য। আকবরকে কব্জা করার ঘটনা প্রমাণ করল আমাদের পুলিশের অদম্য দক্ষতা; যা আগেও তারা প্রমাণ করেছেন।

প্রমাণ করল পুলিশ চাইলে অনেক অপরাধই বন্ধ করতে পারে, অনেক অপরাধীকে জালে আবদ্ধ করতে পারে এবং সর্বোপরি এ কথাও প্রমাণ করল, সব পুলিশই খারাপ নয়, পুলিশের বিভিন্ন পদে এমন অনেকে রয়েছেন যারা কর্তব্যপরায়ণ এবং জনবান্ধব। সে অর্থে সব পুলিশকে ঢালাওভাবে তিরস্কার করা ঠিক নয়।

আমি, মাননীয় বিচারপতি ইমান আলী (তখন ব্যারিস্টার ইমান আলী) এবং ব্যারিস্টার শফিউদ্দিন (বুলবুল) মাহমুদ- এ তিন বাঙালি ব্যারিস্টার ১৯৮১ সালে যুক্তরাজ্য ইমিগ্রেশন অ্যাডভাইজরি সার্ভিসে চাকরি গ্রহণ করি। বগুড়ার মোহাম্মদ আলীর ভাই ব্যারিস্টার আহমেদ আলী তখন সংস্থার দ্বিতীয় শীর্ষ পদে ছিলেন।

সংস্থাটি চালাত যুক্তরাজ্যের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, যে মন্ত্রণালয়ের প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণে ছিল লন্ডন মহানগর পুলিশ এবং পরোক্ষ নিয়ন্ত্রণে ছিল অন্যান্য এলাকার পুলিশ। সেই অর্থে লন্ডন পুলিশ ছিল আমাদের পরোক্ষ সহকর্মী। তাছাড়াও আমার এবং ব্যারিস্টার (তখনকার) ইমান আলীর দায়িত্ব ছিল পুলিশ, ইমিগ্রেশন কর্মকর্তা, ভিসা কর্মকর্তা, জেল কর্মকর্তা, কূটনীতিকদের ইমিগ্রেশন, রিফিউজি, আসামি হস্তান্তর এবং মানবাধিকার ইত্যাদি আইনে প্রশিক্ষণ দেয়া। সেসব সুবাদে আমাদের সঙ্গে ব্রিটিশ পুলিশের নৈকট্য প্রতিষ্ঠিত হয়। সংস্থাটি ছিল ১৯৭১ সালের ইমিগ্রেশন অ্যাক্ট বলে প্রতিষ্ঠিত ইমিগ্রেশন ন্যায়পাল।

চাকরি শুরু করার পরই আমার জানতে ইচ্ছা করছিল যুক্তরাজ্যে মানুষ কেন পুলিশকে জনবান্ধব মনে করে এবং কেনই বা বাংলাদেশে তার উল্টোটা। এটি জানার জন্য আমি পড়াশোনার পাশাপাশি পুলিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে বিস্তারিত আলাপ করেছি। ছাত্র হিসেবে লন্ডন যাওয়ার পর প্রথমই জেনেছিলাম রাস্তা চিনিয়ে দেয়া পুলিশের বড় কাজ। যুক্তরাজ্য ইমিগ্রেশনের চাকরি ছেড়ে ১৯৯৩ সালে দেশে ফিরে আইন পেশা শুরু করার পর বুঝতে পারলাম পুলিশের প্রতি মানুষের যে অনীহা, শ্রদ্ধা এবং বিশ্বাসের অভাব তা অমূলক নয়।

এরপর ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল এবং সবশেষে বিচারপতি পদে যাওয়ার পর এদেশের পুলিশকে আরও কাছ থেকে দেখার ও জানার সুযোগ হয়েছিল। তখন এমন পুলিশও দেখেছি, যাদের দেবতুল্য বলা যায়, আবার এমনও দেখেছি, যারা আক্ষরিক অর্থেই পথভ্রষ্ট। আমরা এসআই আকবরের ব্যাপারেই দুই ধরনের পুলিশ দেখতে পাই। এক ধরনের মধ্যে আকবর নিজে, তার সহআসামিরা এবং সিলেট পুলিশের ঊর্ধ্বতনরা; যারা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে আকবরকে পালাতে সাহায্য করেছিলেন, পরামর্শ দিয়েছিলেন অথবা তাকে ৫৪ ধারায় গ্রেফতার না করে বা নজরদারিতে না রেখে পালানোর পথ সুগম করেছিলেন।

তারা নিশ্চিতভাবে দায় এড়াতে পারেন না। এটি নেহায়েতই সৌভাগ্য আকবর ধরা পড়েছে, যা ঘটনাচক্রের আকস্মিকতার কারণে হয়েছে। নয়তো পশ্চিমবাংলার কোটি কোটি বাঙালির, যাদের চেহারা, ভাষা, সমনৃগোষ্ঠীভুক্ত হওয়ায়, আমাদের থেকে আলাদা নয়, সঙ্গে মিশে গেলে তাকে খুঁজে পাওয়া অসম্ভব না হলেও দুষ্কর হতো বৈকি। বঙ্গবন্ধুর খুনি মাজেদকেও পাওয়া গেল ৩০ বছর পর, আর তা-ও অনেকটা দৈবক্রমে।

অন্যদিকে আমরা সেসব কর্তব্যনিষ্ঠ, ন্যায়পরায়ণ পুলিশ দেখতে পেলাম, যারা আপ্রাণ চেষ্টা করে অবশেষে আকবরকে ধরলেন। সিলেটের বর্তমানে পুলিশ কমিশনার এবং পিআইবি প্রধানকে এ দলভুক্ত করতে আমার কোনো দ্বিধা নেই। গভীর পর্যালোচনায় আমরা যা দেখতে পাই, তা হল আমাদের দেশে ভালো পুলিশিং এবং মন্দ পুলিশিং নির্ভর করছে পুলিশের ব্যক্তিগত বৈশিষ্ট্যের ওপর। সোজা কথায় ব্যক্তি পুলিশ যখন ভালো মানুষ হয়, তখন তার থেকে ভালো পুলিশি দায়িত্ব পাওয়া যায় আর উল্টোটা হলে ফল হয় উল্টো; আর সমস্যা সেখানেই। পুলিশিং ভালো হবে না খারাপ হবে তা কেন ব্যক্তি পুলিশের বৈশিষ্ট্যের ওপর নির্ভরশীল হবে? এটি নিয়ন্ত্রিত হতে হবে সিস্টেম দ্বারা। এমন সিস্টেম থাকতে হবে, যাতে ব্যক্তি পুলিশ ভালো হোক বা মন্দ হোক, ভালোভাবে তিনি যেন তার দায়িত্ব পালনে বাধ্য থাকেন।

যুক্তরাজ্যের অভিজ্ঞতার আলোকে বলতে পারি, সেখানকার সব পুলিশ যে ধোয়া তুলসীপাতা তা নয়; কিন্তু সেখানে সিস্টেম এমন, তাদের আইন অনুযায়ী দায়িত্ব পালন করতে হয় বিনা ব্যতিক্রমে। সেখানে একজন সামান্য কনস্টেবলকে দেখেছি মদপান করে গাড়ি চালানোর অপরাধে মন্ত্রীকে গ্রেফতার করে বিচারে দিতে, এমনকি বেশি গতিতে গাড়ি চালানোর অপরাধে যুবরানী এনকে থামিয়ে বিচারে দিতে, বেশি গতিতে গাড়ি চালানোর অপরাধে এক কনস্টেবল একজন পুলিশ সুপার পদমর্যাদার কর্মকর্তাকে থামিয়ে তাকে বিচারে দিয়েছিলেন, জনপথে যৌন কর্মী ভেবে (আসলে এক মহিলা পুলিশই যৌন কর্মী সেজেছিলেন আসামি ট্র্যাপ করার জন্য) তাকে প্রস্তাব করার অপরাধে ব্রিটিশ প্রসিকিউশনের সর্বোচ্চ অধিকর্তা ডাইরেক্টর অব পাবলিক প্রসিকিউশনকে গ্রেফতার করে বিচারে দিয়েছিলেন।

প্রধানমন্ত্রী ব্লেয়ারের স্ত্রী, যিনি নিজেও একজন নামি ব্যারিস্টার, চেরি ব্লেয়ারকে বিনা টিকিটে ভ্রমণের জন্য ধরা হয়েছে, এমন ঘটনার ভূরিভূরি নজির রয়েছে। এ কাজগুলো তাদের করতে হয়েছে, তাদের সিস্টেমের বাধ্যবাধকতার কারণে। বাংলাদেশে একজন পুলিশের কনস্টেবল তো দূরের কথা, বড় কর্তাও পারবেন না কোনো মন্ত্রীকে বা তার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে গ্রেফতার করতে বা বিচারে দিতে, কেননা এ সিস্টেম আমাদের দেশে গড়ে উঠেনি। একইভাবে আইন ভঙ্গ করে আকবর, লিয়াকত, প্রদীপ যে কথিত অপরাধ করেছিল তা করেও অনেক পুলিশ পার পেয়ে যাচ্ছেন। অনেক থানায় হাজতিদের হত্যা করা হচ্ছে নির্বিচারে; কারণ এসব বেআইনি কাজ থেকে বিরত থাকতে বাধ্য হওয়ার জন্য সিস্টেম গড়ে ওঠেনি।

পুলিশের ইতিহাস বেশি পুরনো নয়। ১৮২৯ সালে ব্রিটিশ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী স্যার রবার্ট পিল প্রথমবারের মতো লন্ডন মহানগর পুলিশ বাহিনী গঠন করে পুলিশ বাহিনীর সূচনা করেন। যার জন্য পুলিশকে ববিও (রবার্টের সংক্ষেপ) বলা হয়। এটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তিনটি মুখ্য ধারণা এবং নয়টি নীতির ওপর, যা আজও বেদ বাক্যের মতো অনুসৃত হয়। এতে বলা আছে, পুলিশের ক্ষমতা এবং দায়িত্ব জনগণের অনুমোদনের এবং গণশ্রদ্ধার ওপর, জনগণের ইচ্ছা-সহায়তার ওপর এবং আইন মানার ওপর নির্ভরশীল।

বলা আছে, গণসহযোগিতা পেলে বলপ্রয়োগের প্রয়োজন হয় না, গণসমর্থন আদায়ের জন্য প্রয়োজন আইন প্রয়োগে নিরঙ্কুশ নিরপেক্ষতা প্রদর্শন, প্রতিটি মানুষের প্রতি বন্ধুত্ব এবং সেবামূলক প্রবৃত্তি প্রদর্শন, ভদ্র আচরণ। অপরিহার্য না হলে বলপ্রয়োগ না করার এবং করলেও ঠিক যতটুকু প্রয়োজন তার বেশি নয়, অর্থাৎ ন্যূনতম। সবসময় জনগণের সঙ্গে এমন সম্পর্ক রাখা যাতে জনগণ মনে করেন, তারাই পুলিশ এবং পুলিশই জনগণ। নিজেদের কাঁধে বিচারিক দায়িত্ব তুলে না নেয়া।

উল্লেখযোগ্য, আগে ব্রিটিশ পুলিশ ছিল নিরস্ত্র এবং এমনকি এখনও কিছু সশস্ত্র পুলিশ ছাড়া অন্য সবাই নিরস্ত্র এবং এভাবেই তারা সাফল্যের সঙ্গে অপরাধ দমন করতে পারছে মূলত জনসমর্থন নিয়ে। স্কটল্যান্ডে ১৮২২ সালে এবং আয়ারল্যান্ডে ১৮২২ সালে আঞ্চলিক পুলিশ গঠিত হয়েছিল। লন্ডন পুলিশ গঠনের পর ১৮৩৯ সালের কাউন্টি পুলিশ অ্যাক্ট অনুযায়ী এলাকাভিত্তিক পুলিশ বাহিনী গঠিত হয়। পূর্বে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে ছিলেন স্থানীয়ভাবে গঠিত কনস্টেবল এবং নৈশপ্রহরীরা; যারা কেন্দ্রীয় সরকার কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত ছিলেন না, অনেকটা আমাদের চৌকিদারদের মতো।

পলাশী যুদ্ধের আগে বঙ্গদেশে পুলিশি দায়িত্ব পালন করতেন স্থানীয় দেওয়ান বা জায়গিরদারদের লাঠিয়ালরা, যাদের কোতওয়াল বলা হতো। কেন্দ্রীয় কোনো ব্যবস্থা ছিল না, নবাবদের নিজস্ব প্রতিরক্ষার বাহিনী ছাড়া। পলাশী যুদ্ধে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির জয়ের পর পুলিশি কাজে সাবেক কোতওয়ালদের নিয়োগ দেয়া হয়, তা-ও আঞ্চলিক ভিত্তিতে, কেন্দ্রীয়ভাবে নয়।

সিপাহি যুদ্ধের পর ১৮৫৭ সালে ব্রিটিশ সরকার কোম্পানির হাত থেকে ভারত শাসন নিজের হাতে তুলে নেয়ার পর ভারতবর্ষের জন্য ১৮৬১ সালে ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অ্যাক্ট প্রণীত হয়, যার ওপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয় ভারতের জন্য কেন্দ্রীয় পুলিশ, ভারতীয় ইম্পেরিয়াল পুলিশ নামে। ১৯২০ সাল পর্যন্ত এ বাহিনীতে ভারতবাসীরা নিষিদ্ধ ছিলেন। সে সময়টি এমনই ছিল, যখন ঝাঁসির রানীর ডাকে সারা ভারতে শুরু হয় ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা যুদ্ধ।

এছাড়া তখন বঙ্গদেশেও বিরাজ করছিল অগ্নিযুগের বাঘা যতীন, মাস্টার দা, ক্ষুদিরাম প্রমুখদের যুদ্ধ যা কাঁপিয়ে তুলেছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ভিত। তাই পুলিশদের শেখানো হল যোদ্ধাদের দমন করতে এবং হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করে সাম্রাজ্যের স্থায়িত্ব নিশ্চিত করতে। গোটা ব্রিটিশ সময়ই একই ধারায় অর্থাৎ দমন-পীড়ন নীতি মেনেই চলেছে ভারতে পুলিশি কর্মকাণ্ড। তখন তাদের অপরাধ দমনের চেয়ে বরং ভারতবাসীকে পেটাতেই শিক্ষা দেয়া হতো।

ইংরেজ শাসনের অবসানের পর ঔপনিবেশিক লাঠিপেটা মনোভাববর্জিত জনগণের পুলিশ গঠন প্রক্রিয়াটাই ছিল প্রত্যাশিত। কিন্তু পাকিস্তান সৃষ্টির পরই সেখানে শুরু হয় অগণতান্ত্রিক ব্যবস্থা, রাওয়ালপিণ্ডি, ষড়যন্ত্র লিয়াকত আলী হত্যাকাণ্ড প্রভৃতি। সংবিধান প্রণয়নে লেগে যায় দীর্ঘ ৯ বছর। পাকিস্তানের পূর্ব এবং পশ্চিম অঙ্গে সংসদ সদস্য ভাগাভাগি প্রভৃতি প্রশ্নে বাদানুবাদে চলে যায় বছরের পর বছর। জিন্নাহ এবং পরবর্তী সময়ে গোলাম মোহাম্মদের স্বৈরাচারী মনোভাবের কারণে কোনো প্রগতিশীল পরিকল্পনাই এগোতে পারেনি।

১৯৪৭ থেকে ৫৮ পর্যন্ত মোট ৬ জন প্রধানমন্ত্রী বদল হয়েছেন। ৫৮-তে আসে দীর্ঘ সামরিক শাসন। সামরিক শাসকরাও পুলিশকে একইভাবে তাদের স্বার্থে ব্যবহার করেছেন ইংরেজ ঔপনিবেশিক শাসকরা যেভাবে করত। তাই তারাও পুলিশকে গণবান্ধব বাহিনীতে পরিণত করার চেষ্টা না করে লাঠিপেটা বাহিনীতেই রাখার চেষ্টায় লিপ্ত ছিলেন।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু দেশের সব ক্ষমতার মালিক জনগণ- এ মন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে পুলিশকে স্বাধীন দেশের মানুষের সেবাদানকারী বাহিনীতে সাজানোর প্রক্রিয়া শুরু করলেও ’৭১-এর পরাজিত খুনিদের দ্বারা শহীদ হওয়ার কারণে শেষ করতে পারেননি। এরপর শুরু হয় জিয়া-মোশতাকের সামরিক শাসন এবং সেই লাঠি পেটানো পুলিশতন্ত্র। জিয়ার অন্তর্ধানের পরও সেই অবস্থা থাকে। প্রথমে এরশাদ ও পরে খালেদাও পুলিশকে ব্যবহার করেছেন তাদের ক্ষমতা পাকাপোক্ত রাখার জন্য।

আর পুলিশ কর্তৃক বিচারবহির্ভূত হত্যা শুরু হয়েছিল চারদলীয় জোট সরকারের আমলে। অপারেশন ক্লিন হার্টের মাধ্যমে চিহ্নিত ব্যক্তিদের নির্দ্বিধায় হত্যা করার ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছিল তখন। সেই সময় বিশেষ ক্ষমতা আইনের ৩ ধারা বলে বিনা বিচারে প্রতিদিনই বহু লোককে গ্রেফতার করা হতো বলে পুলিশে চলছিল ব্যাপক গ্রেফতার বাণিজ্য, যা সৌভাগ্যবশত এখন হচ্ছে না। পরে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের দল ক্ষমতায় আসার পর ২০০৯ থেকে শুরু হয় পুলিশকে গণবান্ধব দেশপ্রেমী বাহিনীতে রূপান্তর প্রচেষ্টা।

কীভাবে পরিবর্তন করা যায়, তা স্থির করার জন্য প্রয়োজন বিশেষজ্ঞদের মতামত, যাতে থাকতে হবে সুপ্রিমকোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি, অবসরপ্রাপ্ত ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তা, অবসরপ্রাপ্ত ঊর্ধ্বতন সরকারি কর্মকর্তা, আইনজ্ঞ, বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাপক, ঊর্ধ্বতন সাংবাদিক, মানবাধিকার কর্মী, ঊর্ধ্বতন সামরিক কর্মকর্তা সমন্বয়ে শক্তিশালী কমিটি গঠন করে তাদের পরামর্শ গ্রহণ। এ সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর অনেক দেশপ্রেমিক জনবান্ধব ব্যক্তিকে পুলিশের উচ্চ পদে চাকরি দিয়েছেন।

কিন্তু ব্যক্তির পরিবর্তন নয়, বরং প্রয়োজন সিস্টেম ঢেলে সাজানো, পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা যেন বিলেতি পুলিশের মতো আইন মানতে এবং জনবান্ধব হতে স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাধ্য থাকেন। করোনার বিপজ্জক পরিস্থিতিতে নিজেদের জীবনপণ করে এবং ২০১৪ সালের নির্বাচনের পর বিএনপি-জামায়াতের জ্বালাও-পোড়াও নির্মমতার সময়ও বহু নিরীহ পুলিশকে জীবন দিতে দেখেছি। এগুলোও ভুলে যাওয়ার নয়; কিন্তু সব শেষে একটাই কথা, সিস্টেমকে ঢেলে সাজাতে হবে, পুলিশকে দোষমুক্ত, ত্রুটিমুক্ত করার জন্য, জনগণের পুলিশে রূপান্তরের জন্য।

তার আগ পর্যন্ত যা করা প্রয়োজন তা হল একটি পুলিশ নালিশ সংস্থা, যা যুক্তরাজ্য এবং ভারতের রাজ্যগুলোতে রয়েছে। যাতে প্রধান হিসেবে থাকবেন হাইকোর্টের একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি, সদস্য হিসেবে একজন অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ মহাপরিদর্শক বা অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক, সাংবাদিক, মানবাধিকার কর্মী, অধ্যাপক ইত্যাদি।

সিলেটের বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়িতে সিসিটিভির রেকর্ড যেভাবে পরিবর্তন করা হয়েছিল, সেই ধরনের পরিবর্তন করে যেন প্রমাণ ধ্বংস করা না যায়, সে উদ্দেশ্যে প্রতি জেলার, প্রতি থানার সিসিটিভির সঙ্গে সরাসরি জেলার এসপির অফিসের যোগাযোগ থাকতে হবে, যাতে এসপি অফিস থানায় কী হচ্ছে তা তাৎক্ষণিক মনিটর করতে পারে।

মাননীয় বিচারপতি হামিদুল হক সাহেব থানায় বা রিমান্ডে নির্যাতন বন্ধের জন্য এক অসাধারণ রায় দিয়েছেন, যা আপিল বিভাগ অনুমোদন করেছেন। এ রায়ের নির্দেশগুলো মেনে চললে পুলিশ নির্যাতন বহুলাংশে কমবে। কিন্তু এটি পালিত হচ্ছে কিনা তা দেখার এবং না হলে তা আদালতের নজরে আনার দায়িত্ব কিন্তু আইনজীবীদের। আমার মনে হয় না, তারা সে দায়িত্ব যথাযথ পালন করছেন। অনেকে হয়তো এ রায়ের কথা জানেনই না।

কক্সবাজারে মেজর সিনহা হত্যার পর কর্তৃপক্ষ প্রতিটি চেকপোস্টে সিসিটিভি স্থাপন করার প্রশংসনীয় উদ্যোগ নিয়েছেন; যা নিশ্চিতভাবে অপরাধ কমাতে পারবে। এগুলো ততদিন পালন করতে হবে, যতদিন না বিশেষজ্ঞ কমিটির পরামর্শ অনুযায়ী পুলিশে সংস্কার আনা হয়। নিষ্ঠাবান, জনবান্ধব পুলিশিং যেমন অপরিহার্য, পুলিশিংয়ের নামে নির্মমতা ঠিক তেমনি অগ্রহণযোগ্য। সম্প্রতি মহামান্য রাষ্ট্রপতি বলেছেন, মানুষ যেন পুলিশকে ভয়ের চোখে না দেখে। আমি যখন প্রথম লন্ডন গেলাম, তখন বর্ণ আক্রমণের ভয়ে আমরা আতঙ্কিত থাকতাম বলে একজন পুলিশ দেখলে আমাদের মনে স্বস্তি পেতাম। সেটাই উচিত পুলিশের ভাবমূর্তি আর তা হতে হবে সিস্টেমের মাধ্যমে।

শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক : আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি