Main Menu

কবি দিলওয়ার : ক্বীন-ব্রীজে যিনি সূর্যোদয় দেখতেন

ব্রিটিশ শাসন আমলের বলতে হবে শেষের দিক। বিষ্ফোরোম্ভিক জাতীয় রাজনীতি। অন্যদিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ঢামাডোল ঠিক সেই সময়ে ১৯৩৭ সালের ১লা জানুয়ারী সিলেটের দক্ষিন সুরমাস্থ ভার্তখলা গ্রামের ঐতিহ্যবাহী খান পরিবারে এক ছোট্ট শিশুর আবির্ভাব। নাম রাখা হয় দিলওয়ার খান। বাড়ির কাছেই সুরমা নদী,ক্বীন ব্রিজে মানুষের পথ চলা,ট্রেনের শব্দ -এই সবের মধ্যেই কবির বড় হয়ে উঠা। সিলেটে গণভোট দেশ ভাগ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের বার্মা দখল , সিলেট দখলের প্রস্তুতি এইসব কবির শৈশব স্মৃতি।

বিভাগ উত্তর কালে যুগভেরিতে লিখার মাধ্যমে কবির আবির্ভাব -কবিতার নাম সাইফুল্লাহ হে নজরুল।
দেশ ভাগ হল। দ্বিখন্ডিত সিলেট। মানচিত্রের পরিবর্তন ঘটলেও সাধারনের ভাগ্যের পরিবর্তন না ঘটায় ক্ষিপ্ত কিশোর সাধারনের মধ্যেই মিশে যান। পূর্ব পুরুষের বুনিয়াদী খেতাব খান পরিত্যাগ করে দিলওয়ার নামে পরিচিত হয়ে উঠেন। অসাধারন পরিবারে জন্ম নেয়া মানুষটি হয়ে উঠেন অতি সাধারনের।
তাঁর পিতার নাম মৌলভী হাসান খান আর মা মোচ্ছাম্মৎ রহিমুন্নেছা। ১৯৫২সালে সিলেটের রাজা জি সি হাই স্কুল থেকে প্রবেশিকা এবং ১৯৫৪ সালে এমসি কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন কবি।

দিলওয়ার রাজা জিসি হাই স্কুলে নবম শ্রেণীর ছাত্র থাকাকালীন সময় মুসলিম মিয়া নামক জনৈক শিক্ষক ছাত্রদের বাংলার কৃষক নিয়ে একটি রচনা লিখতে বলেন। অনেকে অনেক কিছু লিখলেও দিলওয়ারের লেখাটিকে ব্যতিক্রম বলে শিক্ষকের নিকট প্রতীয়মান হয়। বাংলার কৃষকের এক পরিপূর্ন চিত্র যেন ফুটে উঠেছে তাঁর লেখায়। এই অনবদ্য লেখাটি পড়ে শিক্ষক এতো বেশি আবেগাপ্লুত হন যে দিলওয়ারকে আরও বেশি লেখালেখিতে আত্মনিয়োগে তিনি উৎসাহিত করেন। দশম শ্রেণীর ছাত্র থাকাকালীন বি বি সি বাংলা বিভাগ কর্তৃক আয়োজিত রচনা প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে দিলওয়ার পুরুস্কার জিতে নেন। শিক্ষকের উৎসাহ ও শৈশবে পুরুস্কার প্রাপ্তি কবিকে লেখালেখিতে আরও বেশি অনুপ্রাণিত করে তুলে।

মনে অসীম সাহস ও মনোবল থাকলেও শারীরিক অসুস্থতা ছিল কবির নিত্যসঙ্গী। শারীরিক কারনে ইন্টামিডিয়েট পাশ করার পর লেখাপড়ার পাঠচুকিয়ে শিক্ষকতা পেশায় আত্মনিয়োগ করেন তিনি। পেশাদারিত্বের কঠিন শৃঙ্খল কবিকে বেশি দিন আবদ্ধ করে রাখতে পারেনি। মফস্বল শহর সিলেট ছেড়ে ফাঁড়ি দেন ঢাকায়। এবার জীবন ও জীবিকার তাগিদে সাংবাদিকতাকে পেশা হিসাবে বেঁচে নেন। ১৯৬৭সালে সহকারী সম্পাদক হিসাবে যোগ দেন দৈনিক সংবাদে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর জাতীয় দৈনিক গণকণ্ঠেরও সহকারী সম্পাদক ছিলেন তিনি।

১৯৭৪সালের সংবাদপত্র নিয়ন্ত্রণ আইনের প্রেক্ষিতে আরও অনেকের মতো কবি দিলওয়ারকেও চাকুরী হারাতে হয়। এবার ক্বীন ব্রীজ তাকে আবারও হাতছানি দিয়ে ডাকে। সিলেটের কবি ফিরে আসেন আবারও সিলেটে। এর পর থেকে নিরলস কাব্যচর্চাই ছিল কবির পেশা ,নেশা ও বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন।

জীবনের বেশির ভাগ সময় কাটিয়েছেন নিজ জন্মস্থানে। নিজ জন্মমাটি আর ক্বীনব্রীজের সূর্যোদয় তাঁকে আষ্টেপৃষ্টে আঁকড়ে ধরে রাখলেও তিনি কখনও কোন সীমা প্রাচীরের মধ্যে চিন্তা ও কর্মকে আবদ্ধ রাখেননি। পৃথিবীর কবি হিসাবে নিজেকে অধিষ্ঠিত করার প্রয়াস চালিয়েছেন নিরন্তর। দিলওয়ারের কবিতায় সমাজ ,ধর্ম ও ভৌগোলিকতার কোন সীমারেখা নেই। নিজেকে সীমার মধ্যেই আবদ্ধ রেখে কবি অসীমকে অতিক্রম করতে হয়েছেন সক্ষম।
ভাষা আন্দোলন ,স্বাধিকার ও স্বাধীনতা আন্দোলনে তাঁর কবিতা আমাদের ঘুনে ধরা মন ও মানসিকতাকে উজ্জীবিত করেছে। গণদাবি ও গণরায় যেখানেই উপেক্ষিত হয়েছে সেখানেই দিলওয়ারের কবিতা গণমানুষের পক্ষ নিয়েছে। ভাষা আন্দোলনকালীন সময়ে দিলওয়ার লিখেন –
আয়রে চাষী মজুর কুলি মেথর কুমার কামার /বাংলাভাষা ঢাক দিয়েছে বাংলা তোমার আমার। ..,,,,ও হো আয়রে ছুটে মেহনতিরা /ছিঁড়তে ভাষার বৈরীশিরা /শোষণমুক্ত গড়তে সমাজ /নেইকো সময় থামা-র /বাংলা তোমার আমার।
চল্লিশ থেকে ষাটের দশকের প্রত্যেক কবিরাই দেশ মা ও মাটি নিয়ে লেখার চেষ্টা করেছেন তবে দেশ মাটি ও মানুষের প্রতি এমন দরদী ভালোবাসার প্রকাশ দিলওয়ারের কবিতা ব্যতীত খুব কম কবিদের কবিতায় দেখা যায় । ‘রক্তে আমার অনাদি অস্থি’ কবিতায় কবি লিখেন -‘পদ্মা তোমার যৌবন চাই /যমুনা তোমার প্রেম, /সুরমা তোমার কাজল বুকের /পলিতে গলিত হেম /সাগরদুহিতা এই বাংলার /নিশিগন্ধার রাতে -/ঊর্মিদোদুল জনক আমার /মিলেছে মায়ের সাথে ,/সূর্যমুখীর সহোদরা এই /নারীর গর্ভ কোষে,-/বাংলায় আমি জন্ম নিয়েছি /জারিত স্বর্ণ রসে ।/পদ্মা যমুনা সুরমা মেঘনা /গঙ্গা কর্ণফুলী /তোমাদের বুকে আমি নিরবধি /গনমানবের তুলি ।/কতো বিচিত্র জীবনের রঙ /চারিদিকে করে খেলা /মুগ্ধ মরণ বাঁকে বাঁকে ঘুরে /কাটায় মারণ বেলা।/রেখেছি আমার প্রাণ স্বপ্নকে /বঙ্গপোসাগরেই /ভয়াল ঘূর্ণি,সে আমার ক্রোধ /উপমা যে তাঁর নেই !/এই ক্রোধ জ্বলে আমার স্বজন /গণমানবের বুকে /যখন বোঝাই প্রাণের জাহাজ /নর দানবের মুখে !/পদ্মা সুরমা মেঘনা যমুনা /অশেষ নদী ও ঢেউ /রক্তে আমার অনাদি অস্থি /বিদেশে জানেনা কেউ।’

ভিয়েতনাম যুদ্ধকালীন সময়ে আমরা কবিকে লিখতে দেখি -‘নরদানবের বংশ /করবো সমূলে ধ্বংস /বুঝে নাও আজ এই ধরণীর /প্রাপ্য যে যার অংশ।’
বিশ্বের তাবৎ মুক্তিকামী মানুষকে উজ্জীবিত করতে কবির আহবান -‘ যত দিন বেঁচে আছো ততোদিন মুক্ত হয়ে বাঁচো ,/আকাশ মাটির কন্ঠে যেন শুনি তুমি বেচেঁ আছো।’
নিজের পরিচয়কে কবি এভাবেই ব্যক্ত করেছেন কবিতায় -শব্দব্রহ্ম শূন্যে কোথাও নেই /বীর্য আমার আর্য অনার্যেই /আমার জাতক সেমিটিক হ্যামিটিক /আমি আদিম /চলিষ্ণু আধুনিক।
দিলওয়ারের কবিতায় স্বদেশের কোন ভৌগোলিক সীমারেখা নেই। সমগ্র পৃথিবীটাই তাঁর স্বদেশ আর মানুষরাই হচ্ছে তাঁর স্বজাতি। কবির বহুল পঠিত কবিতার পংক্তিটাই হচ্ছে এই ‘পৃথিবী স্বদেশ যার ,আমি তাঁর সঙ্গী চিরদিন।’
‘যুদ্ধকালে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে গাওয়া হয় তাঁর লেখা গান -‘চলছে মিছিল চলবে মিছিল /চলবে চলবে চলবে /লক্ষ্য পথে রাত্রির মতোন জ্বলবে জ্বলবে। ‘ অথবা ‘বাংলা তোমার আজ শুধু এক নাম /মরণ বিজয়ী মুক্তির সংগ্রাম। ‘

দেশ ,মানুষ ,মানবতা ও পৃথিবী দিলওয়ারের কবিতার উপজীব্য হলেও নিজ জন্মভূমি তাঁর লেখালেখি থেকে বাদ যায়নি। জন্মভূমি সিলেটকে নিয়ে লিখেছেন অপূর্ব সুন্দর গান ও কবিতা। ক্বীন-ব্রীজে সূর্যোদয় কবিতায় কবি লিখেন -‘সহসা ফিরিয়ে চোখ দিয়ে দেখি দূর পুবাকাশে /তরুণ রক্তের মতো জাগে লাল সাহসী অরুণ /পাখির কাকলি জাগে। ঝিরঝিরে শীতল বাতাসে /দিনের যাত্রার শুরু। অন্তরালে রজনী কুরণ !/ধারালো বর্শার মতো স্বর্ণময় সূর্যরশ্মি ফলা /ক্বীন-ব্রীজে আঘাত হানে। শুরু হয় জনতার চলা। ‘
‘তুমি রহমতের নদীয়া /দোয়া কর মোরে হজরত শাহ জালাল আউলিয়া। ‘ দিলওয়ারের এই অতি জনপ্রিয় মরমী গানটির মাধ্যমে ষাটের দশকের প্রথম দিকে সিলেট বেতারের যাত্রা শুরু হয়।
দিলওয়ারের মরমী গানে তাঁর ধর্ম ও বিশ্বাসের প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠে -‘মুর্শিদ আমি খুঁজবো না গো /বন জঙ্গলে যাইয়া /আমার মাঝে আমার মুর্শিদ /আছে যে পথ চাহিয়া।
আধুনিক চিন্তা ও চেতনায় উজ্জীবিত ,বিজ্ঞান মনস্ক মানুষ হিসাবেই কবি নিজেকে গড়ে তুলেছেন।স্বভাব কবি হিসাবে ভালোবেসেছেন মানুষকে। অনিন্দ্য সুন্দর প্রকৃতির কাছাকাছি থেকে তীক্ষ্ন ধারালো চোখ দিয়ে কবি শুধু সমাজকেই দেখেননি সময়ের সাহসী সন্তান হিসাবে মানব মুক্তির স্লোগানে ঋদ্ধ করেছেন নিজেকে।

১৯৫৩সালে ‘জিজ্ঞাসা’ নামে দিলওয়ারের প্রথম কাব্য গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। এর ঠিক এক দশক পরে ১৯৬৪সালে প্রকাশিত হয় তাঁর দ্বিতীয় কাব্য গ্রন্থ ‘ঐক্যতান।’ এর পর থেকে কবির একের পর এক গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। তার শ্ৰেষ্ঠ গ্রন্থদ্বয় ‘বাংলা তোমার আমার ‘ ১৯৭২ সালে আর ‘রক্তে -আমার অনাদি অস্থি ‘ প্রকাশিত হয় ১৯৮১সালে।
বাংলা সাহিত্যে অসামান্য অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার তাঁকে ১৯৮০সালে বাংলা একাডেমি পুরুস্কার প্রদান করে। ২০০৮সালে পান রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ সম্মান ‘একুশে পদক। ‘ এছাড়া কবি বাংলা একাডেমি ফেলোশিপ ছাড়াও লাভ করেন আবুল মনসুর আহমদ সাহিত্য পুরুস্কার ও দেওয়ান গোলাম মর্তুজা স্মৃতি পদক প্রভৃতি।

শারীরিক অসুস্থতা কবির জীবনের মোড়ে মোড়ে বার বার প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করলেও এই অসুস্থতাই কবিকে সান্নিধ্য পাইয়ে দেয় আনিসা নাম্নী এক অবাঙালী মহীয়সীর। চিকিৎসাধীন দিলওয়ার প্রেমে পড়ে যান সেবিকা আনিসার। ১৯৬০ সালে এই আনিসার সাথেই কবি ঘর বাঁধেন। যে কবি অসুস্থতার কারনে লেখাপড়া করতে পারেন নি সেই কবি আনিসার শুশ্রূষা ও প্রেরণায় লিখে যান বাংলা সাহিত্যের অনবদ্য সব কবিতা ও গান, শুধু একদিন দুইদিন নয় পুরো দেড় দশক।
১৯৭৫সালে দুরারোগ্য ব্যাধি টিটেনাসে আক্রান্ত হয়ে আনিসা মারা গেলে কবির পরিবারের হাল ধরতে এগিয়ে আসেন আনিসারই সহোদরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উর্দূতে অনার্সের ছাত্রী ওয়ারিসা খাতুন। ১৯৭৫সালেই কবি ওয়ারিসা খাতুনকে বিয়ে করেন।
কবি পুত্র কিশওয়ার ইবনে দিলওয়ার কবিতা লিখতেন। এক সময় কিশওয়ার মানসিক ব্যাধি সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত হলে কবি একেবারেই ভেঙে পড়েন। ১৯৯৭ সালে বাংলা একাডেমি কর্তৃক কবিকে দেওয়া রাষ্ট্রীয় ভাতাও কমিয়ে দেওয়া হয়। এরইমধ্যে স্ত্রী ওয়ারিসা ও পুত্র কিশওয়ারের মৃত্যু কবিকে শারীরিক মানসিক ও অর্থনৈতিক ভাবে একেবারে পঙ্গু করে দেয়।
২০১৩সালের ১০ই অক্টোবর মৃত্যু পূর্ব সময় পর্যন্ত তীব্র মনোকষ্ট আর শারীরিক অসুস্থতা এর কোনটাই কবির কলমকে থামিয়ে দিতে পারেনি। আমৃত্যু কবি মানুষ কে নিয়ে লিখেছেন গনমানুষের মুক্তির স্বপ্ন দেখেছেন।