Main Menu

একাত্তরে যোদ্ধাক্যাম্পে চিকিৎসা দিতেন ডা. কুন্ডু

‘৭১-এ মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় একজন চিকিৎসক হিসেবে ময়মনসিংহ অঞ্চলের সীমান্তবর্তী একাধিক যুদ্ধক্ষেত্রে এবং ভারতের বিভিন্ন মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে চিকিৎসক হিসেবে দায়িত্বপালন করেছিলেন স্বনামধন্য প্যাথলজিস্ট ডা. কুন্ডু। পুরো নাম কমল কৃষ্ণ কুন্ডু। এ সময় তিনি সান্নিধ্য পেয়েছেন দেশের খ্যাতনামা অনেক বীর মুক্তিযোদ্ধা, সেনা কর্মকর্তা এবং রাজনীতিবিদদের। কর্নেল তাহের থেকে শুরু করে রাজনীতবিদ রফিক উদ্দিন ভুইয়ার মতো ব্যক্তিদের সান্নিধ্যে তিনি ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধে ডা. কুন্ডুর এ গৌরবময় ভূমিকার কথা আজকের প্রজন্মের অনেকের কাছেই অজানা।

পাবনা চাটমোহরের জমিদার পরিবারের কৃতি সন্তান ডা. কুন্ডুর সাথে আলাপে জানা যায়, মুক্তিযুদ্ধের শুরুর সময় তিনি ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে হাউজ সার্জন হিসেবে কর্মরত ছিলেন। শহরের পরিস্থিতি খারাপ হয়ে যাওয়ায় তিনি চলে যান জেলার ফুলপুর উপজেলার বাহাদুরপুর গ্রামে। কিন্তু সেখানেও এক সময় পাকবাহিনী এসে অত্যাচার শুরু করে এবং পয়ারী জমিদার বাড়িতে নির্যাতন শুরু করে। সেখানে পাক বাহিনী একজন অন্তঃসত্ত্বা নারী ও একজন ডাক্তারসহ অনেক মানুষকে হত্যা করে। এক পর্যায়ে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা জানতে পারেন এখানে একজন ডাক্তার আছেন। মুক্তিসেনারা দলবেঁধে এসে ডাক্তার কুন্ডুকে তাদের সাথে যাওয়ার অনুরোধ করেন। তখন ডা. কুন্ডু তাদের সাথে চলে যান। এ সময় ওই গ্রামের তিন ভাই জোর্তিময় ঘোষ, রনজিৎ ঘোষ এবং অজয় ঘোষ ডাক্তার কুন্ডুর সঙ্গী হন। সময়টা হবে এপ্রিল মাসে। এরপর মুক্তিবাহিনীর গাইডে তারা পথ চলতে শুরু করেন। কিন্তু শেরপুরের নালিতাবাড়ীর তন্তর গ্রামে গিয়ে পাকবাহিনীর হামলায় পড়েন। এ সময় মুক্তিযোদ্ধাদের কাছ থেকে তারা ৪ জন আলাদা হয়ে যান।

এরপর ভোরে তারা ৪ জন সীমান্তবর্তী ভোগাই নদীর তীরে উপস্থিত হন। কিন্তু সাঁতার দিয়ে খরস্রোতা নদী পার হতে গিয়ে তিনি এবং অজয় অপর দুজনের কাছ থেকে আবার বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। পরে স্থানীয় এক কৃষকের সাথে কথা বলে তারা সীমান্তে পৌঁছতে সক্ষম হন। এক সময় মুক্তিযোদ্ধারা তাদের দেখতে পান এবং এগিয়ে এসে তাদের নিয়ে যান। সেখানে মুক্তিযোদ্বা আবুল হাশেমসহ পরিচিতি অনেকের সাথেই দেখা হয় ডা. কুন্ডুর।

এরপর তিনি যান মেঘালয়ের ঢালু ক্যাম্পে। সেখানে মুক্তিসেনারা একজন ডাক্তার পেয়ে খুবই খুশি হন। মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ তাকে নিয়ে যান বিএসএফের ইনচার্জ বালজিৎ সিংয়ের কাছে। এরপর তার সাথে দেখা হয় বিশিষ্ট আওয়ামী লীগ নেতা রফিক উদ্দিন ভুইয়ার সাথে। রফিক উদ্দিন ভুইয়া তাকে তেলঢালা ক্যাম্পে নিয়ে যান। তেলঢালাতে বেঙ্গল রেজিমেন্টের হেড কোয়ার্টারে তিনি অবস্থান করেন।

ডা. কুন্ডু জানান, তিনি প্রতিদিন সকালে মেডিক্যাল ডিসপেনসারিতে যেতেন। সেখানে জওয়ান এবং মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা দিতেন। তিনি বলেন, তৎকালীন সেনা কর্মকর্তা আনোয়ার হোসেনকেও তিনি জরুরি চিকিৎসার প্রয়োজনে একবার কলকাতাতেও নিয়ে যান। এতদিন বাবা-মার সাথে তার কোনো যোগাযোগ ছিল না। কিন্তু কলাকাতায় গিয়ে তিনি বাবা মার সন্ধান পান এবং তাদের সাথে দেখাও করেন।

ডা. কুন্ডু জানান, বিভিন্ন অপারেশনেও তিনি যেতেন ডাক্তার হিসেবে। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ঐতিহাসিক কামালপুর যুদ্ধের কথা। বাংলাদেশে ফিরে আসা প্রসঙ্গে জানান, ময়মনসিংহ সীমান্ত দিয়ে ভারতীয় এবং মুক্তিবাহিনীর সাথেই তিনি ময়মনসিংহে আসেন। যুদ্ধ শেষে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী তাকে খবর দেয়। ১৯৭২ সালে তিনি মুক্তিযোদ্ধা সনদ পান। এ সময় সেনা কর্মকর্তারা তাকে সেনাবাহিনীতে যোগ দেয়ার অনুরোধ জানালে তিনি তার মূল পেশা অর্থাৎ চিকিৎসকের দায়িত্বেই ফিরে আসেন। এরপর রেখে যাওয়া একটি অসমাপ্ত প্রশিক্ষণে যোগ দেন।

পরবর্তীতে তিনি ঢাকা এবং ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজে সুনামের সাথে অধ্যাপনা পেশায় ছিলেন। তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজের প্যাথলজী বিভাগে সহকারী অধ্যাপক এবং হিস্টোপ্যাথলজী সেকশনের ইনচার্জ হিসেবে ১১ বছর কর্মরত ছিলেন। ২০০২ সালে তিনি ময়মনসিংহ ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ থেকে অবসর নিয়ে কমিউনিটি বেজড মেডিক্যাল কলেজে যোগ দিয়ে অধ্যাপক হিসেবে ২০১০ সালে সেখান থেকে অবসর নেন। তবে এখনও তিনি সুনামের সাথে তার চিকিৎসা সেবা চালিয়ে যাচ্ছেন। ময়মনসিংহ নগরীর সেহড়া এলাকায় কুন্ডু প্যাথলজী নামের চেম্বারে তিনি নিয়মিত বসেন। ময়মনসিংহ নগরীর সর্বমহলে সুনাম এবং পরিচিত আছে ডা. কুন্ডুর।