Main Menu

আফগান যুদ্ধের ২০ বছর: এর কী দরকার ছিল?

দীর্ঘ ২০ বছর পর আফগানিস্তান থেকে সব সেনা প্রত্যাহার করে নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্য। আগামী ১১ সেপ্টেম্বর ওই সেনারা আফগানিস্তান ছাড়বেন।

১১ সেপ্টেম্বর তারিখটিও এখানে উল্লেখযোগ্য। কারণ ঠিক ২০ বছর আগে ২০০১ ‍সালের ১১ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের টুইন টাওয়ারে আল-কায়দার হামলার পর প্রতিশোধ নিতে আফগানিস্তানে অভিযান শুরু করে যুক্তরাষ্ট্র নেতৃত্বাধীন বাহিনী। উৎখাত করা হয় ওই সময়ে আফগানিস্তানে ক্ষমতাসীন তালেবান সরকারকে।

বিবিসি জানায়, আফগানিস্তানে এখনো আড়াই হাজার থেকে সাড়ে তিন হাজার মার্কিন সেনা দায়িত্বরত আছেন। যুক্তরাজ্যের আছেন ৭৫০ সেনাসদস্য। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এ মাসে আফগানিস্তান থেকে নিজেদের সব সেনা প্রত্যাহার করে নেওয়ার ঘোষণা দেন।

দীর্ঘ দুই দশক ধরে আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্র নেতৃত্বাধীন বাহিনীর অবস্থানের উচ্চ মূল্য সব পক্ষকেই চুকাতে হয়েছে। সেই মূল জীবন দিয়ে, জীবনযাপননে ক্ষতি এবং অর্থমূল্যে শোধ করতে হয়েছে।

বিবিসি জানায়, আফগানিস্তানে যু্দ্ধ করতে এসে দুই হাজার ৩০০’র বেশি মার্কিন সেনা নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন ২০ হাজারের বেশি। এছাড়া যুক্তরাজ্যের ৪৫০ জনের বেশি সেনা নিহত এবং অন্যান্য দেশেরও শতাধিক সেনা প্রাণ হারিয়েছেন।

অন্য দিকে এই ২০ বছরে ৬০ হাজারের বেশি আফগান সেনার প্রাণ গেছে। বেসামরিক মানুষ নিহতের সংখ্যা তারও প্রায় দ্বিগুণ।

এতো গেলো প্রাণহানির হিসাব। যুদ্ধে অর্থের অপচয়ও হয়েছে যুক্তির হিসাব না মেনে। আফগানিস্তানে যুদ্ধ পরিচালনার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের করদাতাদের এক ট্রিলিয়ন ‍মার্কিন ডলার ব্যয় করতে হয়েছে।

তাই স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠেছে: এসব কী আসলেও ন্যায়সঙ্গত ছিল?

বিষয়গুলোকে কীভাবে মূল্যায়ন করা হচ্ছে তার উপর এ প্রশ্নের উত্তর নির্ভর করছে।

একটু পেছনে ফিরে দেখা যাক। ১৯৯৬ সাল থেকে ২০০১, এই পাঁচ বছরে চতুর নেতা ওসামা বিন লাদেনের নেতৃত্বে আফগানিস্তানে শক্তঘাঁটি গেড়ে বসেছিল আল-কায়দা। তারা সেখানে জঙ্গি প্রশিক্ষণ ক্যাম্প বানিয়েছে। এমনকি কুকুরের উপর বিষাক্ত গ্যাসের প্রভাব পরীক্ষা করার সুযোগ পেয়েছে। সারা বিশ্ব থেকে ২০ হাজারের বেশি মানুষকে দলে ভিড়িয়েছে এবং তাদের এক একজনকে প্রশিক্ষণ দিয়ে ভয়ঙ্কর জঙ্গি হিসেবে গড়ে তুলেছে।

১৯৯৮ সালে আল-কায়দা কেনিয়া ও তানজানিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাসে হামলা চালিয়ে ২২৪ জনকে হত্যা করে। নিহতদের বেশিরভাগই আফ্রিকার সাধারণ মানুষ।

ওই সময়ে আফগানিস্তানে তালেবান সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় আল-কায়দা সেখান থেকে সক্রিয়ভাবে বিশ্বজুড়ে জঙ্গি কার্যক্রম চালাতে থাকে। ১৯৯৬ সালে আফগানিস্তানের ক্ষমতা দখল করে তালেবান।

যুক্তরাষ্ট্র ওই সময় তাদের আরব মিত্র সৌদি আরবের মাধ্যমে তালেবান সরকারকে চাপ প্রয়োগ করে আফগানিস্তান থেকে আল-কায়দা জঙ্গিদের উৎখাতের চেষ্টা করেছিল। কিন্তু তালেবান সরকার তাতে সাড়া দেয়নি।

২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের টুইন টাওয়ারে আল-কায়দার হামলার পর আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় তালেবান সরকারকে দায়ীদের তাদের হাতে তুলে দিতে বলেছিল। কিন্তু সেবারও তালেবান ওই প্রস্তাব অস্বীকার করে।

তার পরের কয়েকমাসে আফগানিস্তানে তালেবান বিরোধী বাহিনী ‘দ্য নর্দান অ্যালায়েন্স’ যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের বাহিনীর সহায়তায় কাবুলে হামলা চালিয়ে তালেবান সরকারকে উৎখাত করে। আল-কায়দা জঙ্গিরা পাকিস্তান সীমান্তে পালিয়ে যায়।

এ সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্রের একজন জ্যেষ্ঠ নিরাপত্তা কর্মকর্তা বিবিসিকে বলেন, তারপর আফগানিস্তান থেকে আন্তর্জাতিক জঙ্গি হামলার আর কোনো পরিকল্পনা সফল হয়নি। সেক্ষেত্রে বলা যায়, দেশটিতে পশ্চিমা সেনাবাহিনী এবং নিরাপত্তা বাহিনীর উপস্থিতি তাদের লক্ষ্য অর্জনে সফল হয়েছে।

যদিও এটা অবশ্যই খুব স্থুলভাবে বিবেচনা করলে। কারণ, সেখানে যুদ্ধে যে পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে। যুদ্ধে সেখানে সামরিক এবং বেসামরিক উভয় পক্ষকেই অপরিসীম ক্ষতির সম্মুখিন হতে হয়েছে।

২০ বছর হতে চলেছে, এখনো আফগানিস্তানে শান্তি ফেরেনি। গবেষক দল ‘অ্যাকশন অন আর্মড ভায়োলেন্স’ গ্রুপের তথ্য মতে, ২০২০ সালেও বিস্ফোরণে সবচেয়ে বেশি মানুষ আগানিস্তানে নিহত হয়েছেন।

আল-কায়দা, ইসলামিক স্টেট (আইএস) বা অন্যান্য জঙ্গিদলের কোনোটিই সম্পূর্ণ নির্মূল হয়নি। পশ্চিমা বাহিনীর বাকি সদস্যরা চলে গেলে দেশটিতে তাদের পুনরুত্থান হবে।

আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহারের বিষয়ে যুক্তরাজ্যের প্রধান প্রতিরক্ষা কর্মকর্তা নিক কার্টার বলেন, ‘‘আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় আফগানিস্তানে এমন একটি নাগরিক সমাজ তৈরি করেছে যারা তালেবান কী ধরনের জনপ্রিয়তার ভিত্তিতে তাদের বৈধতা চায় তার হিসাব পাল্টে দিয়েছে।

‘‘দেশটি এখন ২০০১ সালের তুলনায় ভালো স্থানে পরিণত হয়েছে এবং তালেবান এখন আগের তুলনায় অনেক উদার হয়েছে।”

কার্টার নিজে বেশ কয়েকবার আফগানিস্তান সফর করেছেন।

তবে অনেক বেশি হতাশার কথা বলেছেন এশিয়া প্যাসেফিক ফাউন্ডেশনের ড. সজ্জন গোহেল। তিনি বলেন, ‘‘সেখানে এখন সত্যিকারের উদ্বেগের পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। আফগানিস্তান আবারও নব্বইয়ের দশকের মত চরমপন্থিদের কারণে রক্তাক্ত ভূমিতে পরিণত হতে পারে।

‘‘এখন নানা দেশ থেকে জঙ্গিরা আবারও আফগানিস্তানে জঙ্গি প্রশিক্ষণ গ্রহণের জন্য যেতে পারবে। কিন্তু পশ্চিমারা এটার বিরুদ্ধে আর কিচ্ছু করতে পারবে না। কারণ, এরইমধ্যে তারা আফগানিস্তানকে পরিত্যাগের প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেছে।”

পশ্চিমা নানা গোয়েন্দা সংস্থাও একই উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।

তবে হয়তো এটাই আফগানিস্তানের অনিবার্য পরিণতি নয়। বরং দেশটির ভবিষ্যত অনেক কিছুর উপর নির্ভর করছে।

আফগানিস্তানে শান্তি ফিরিয়ে আনতে যুক্তরাষ্ট্রের উদ্যোগে কাতারের দোহায় আফগান সরকার ও তালেবান প্রতিনিধিদের সঙ্গে কয়েক দফা বৈঠক হয়েছে। তালেবান ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে এ বিষয়ে একটি চুক্তিও হয়েছে। ওই চুক্তি অনুযায়ী তালেবান আবারও আফগানিস্তানের রাজনীতিতে সক্রিয় হওয়ার সুযোগ পাবে।

‍তাই অনেক কিছু নির্ভর করছে শেষ পর্যন্ত জিতে যাওয়া তালেবানের উপর। প্রথমত, ক্ষমতায় ফিরে যেতে পারলে তারা কী আবারও আল-কায়দা ও আইএস জঙ্গিদের আফগানিস্তানে সক্রিয় হওয়ার এবং এলাকা দখল করার অনুমতি দেবে। দ্বিতীয়ত, যে চুক্তির ভিত্তিতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় আফগানিস্তান ছেড়ে যাচ্ছে সেটার কতখানি বাস্তবায়ন হবে। যে চুক্তির মাধ্যমে আফগানিস্তানে না থেকেও পশ্চিমবিশ্ব দেশটির উপর নিজেদের নিয়ন্ত্রণ রাখার পরিকল্পনা করেছে।

তাই বলা যায়, আফগানিস্তানের ভবিষ্যত নিরাপত্তা চিত্র এখনো অস্বচ্ছ।