Main Menu

অভিনব কায়দায় ১৭ হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করলেন হুজুররা

মাদরাসা লাইনে পড়াশোনা শেষে মসজিদে ইমামতি শুরু করেন পিরোজপুরের রাগীব আহসান। ২০০৬-০৭ সালের দিকে ইমামতির পাশাপাশি একটি এমএলএম কোম্পানিতে মাত্র ৯০০ টাকা বেতনে চাকরি করেন। ২০০৮ সালে প্রতিষ্ঠা করেন একটি এমএলএম কোম্পানি।

ওয়াজ-মাহফিলের আয়োজন করে রাগীব নিজ প্রতিষ্ঠানের প্রচারণা চালাতেন। একসময় ধর্মীয় অনুভূতিকে কাজে লাগিয়ে শরিয়াহভিত্তিক সুদমুক্ত বিনিয়োগের ধারণা প্রচার করে ১০ হাজার গ্রাহকের কাছ থেকে ১১০ কোটি টাকা সংগ্রহ করে ব্যবসা শুরু করেন।

এখন সেই রাগীব ১৫ মামলার আসামি। গ্রাহকের লভ্যাংশ তো দূরের কথা, বিনিয়োগের টাকা ফিরিয়ে না দিয়েই ২০১৯ সাল থেকে আত্মগোপনে যান তিনি। তার নিয়োজিত তিনশ মাঠকর্মীকেও বেতন দেননি।

এভাবেই ২০০৮ সাল থেকে এ পর্যন্ত ১৭ হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে রাগীবের মালিকানাধীন এহসান গ্রুপ। এমনটিই দাবি করেছে র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‍্যাব)। র‍্যাব বলছে, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে রাগীব স্বীকার করেছেন যে, তিনি ১১০ কোটি টাকা নিয়েছেন।

বেশ কজন ভুক্তভোগীর অভিযোগের ভিত্তিতে বৃহস্পতিবার (৯ সেপ্টেম্বর) দিবাগত রাতে র‌্যাব সদর দফতরের গোয়েন্দা শাখা ও র‌্যাব-১০ এর একটি দল রাজধানী ঢাকার শাহাবাগ থানার তোপখানা রোড এলাকায় অভিযান চালিয়ে রাগীব আহসান (৪১) ও তার সহযোগী আবুল বাশার খানকে (৩৭) গ্রেফতার করে। এসময় তাদের কাছ থেকে উদ্ধার করা হয় ভাউচার বই ও মোবাইল ফোন।

শুক্রবার বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে কারওয়ান বাজারে র‍্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান সংস্থাটির সদর দফতরের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।

তিনি বলেন, জিজ্ঞাসাবাদে রাগীব আহসান জানিয়েছেন, তিনি ১৯৮৬ সালে মাদরাসায় পড়াশোনা শুরু করেন। ১৯৯৯ সালে হাটহাজারী মাদরাসা থেকে তিনি পাস করেন। ২০০০ সালে খুলনার একটি মাদরাসা থেকে মুফতি ডিগ্রি লাভ করেন। এরপর মসজিদে ইমামতি করেন।

০৬-০৭ সালের দিকে ইমামতির পাশাপাশি ‘এহসান এস মাল্টিপারপাস’ নামে একটি এমএলএম কোম্পানিতে ৯০০ টাকা বেতনের চাকরি করার মাধ্যমে এমএলএম কোম্পানির আদ্যপ্রান্ত রপ্ত করেন রাগীব। ২০০৮ সালে ‘এহসান রিয়েল এস্টেট’ নামে একটি এমএলএম কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন নিজেই। ওই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ১০ হাজার গ্রাহকের কাছ থেকে ১১০ কোটি টাকা নিয়ে ব্যবসা শুরু করেন।

অর্থ সংগ্রহের ক্ষেত্রে রাগীব ধর্মীয়-আবেগ অনুভূতি ব্যবহার করেন। দেশের ধর্মপ্রাণ মানুষকে আকৃষ্ট করতে শরিয়াহ পদ্ধতিতে সুদমুক্ত বিনিয়োগে ব্যবসার প্রচারণা চালান। নিজের এলাকা পিরোজপুরে ওয়াজ-মাহফিলের আয়োজন করে তার এমএলএম কোম্পানিতে অংশীদার হতে আহ্বান জানান। এভাবে তিনি ১৭টি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। লাখ টাকার বিনিয়োগে রাগীব মাসিক মাত্রাতিরিক্ত টাকা প্রাপ্তির প্রলোভন দেখান। ২০০৮ সালে ১০ হাজার গ্রাহককে যুক্ত করতে সমর্থ হন। পরে গ্রাহকের সংখ্যা লাখেরও বেশি ছাড়িয়ে যায় বলে জানতে পেরেছে র‌্যাব।

জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, রাগীবের তত্ত্বাবধানে ৩০০ মাঠ পর্যায়ের কর্মী ছিল। যাদের কোনো বেতন ছিল না। যদিও তাদের বিনিয়োগ আনার পরিমাণের ওপর ২০ শতাংশ লভ্যাংশ দেয়ার কথা ছিল। এসব পরিকল্পনার মাধ্যমে দ্রুত গ্রাহক সংখ্যা বাড়াতে সক্ষম হন। কর্মী-গ্রাহক সবার সঙ্গে প্রতারণা করেছেন তিনি। কর্মী-গ্রাহকদের কাওকেই লভ্যাংশ পরিশোধ করেননি।

গ্রেফতার রাগীব আহসান জানান, তিনি এহসান গ্রুপের অধীনে ১৭টি প্রতিষ্ঠানের নামে প্রতারণার ফাঁদ তৈরি করেন। প্রতিষ্ঠানগুলো হলো এহসান গ্রুপ বাংলাদেশ, এহসান পিরোজপুর বাংলাদেশ (পাবলিক) লিমিটেড, এহসান রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড বিল্ডার্স লিমেটেড, নূর-ই মদিনা ইন্টারন্যাশনাল ক্যাডেট একাডেমি, জামিয়া আরাবিয়া নূরজাহান মহিলা মাদরাসা, হোটেল মদিনা ইন্টারন্যাশনাল (আবাসিক), আল্লাহর দান বস্ত্রালয়, পিরোজপুর বস্ত্রালয়-১ ও ২, এহসান মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেড, মেসার্স বিসমিল্লাহ ট্রেডিং অ্যান্ড কোং, মেসার্স মক্কা এন্টারপ্রাইজ, এহসান মাইক অ্যান্ড সাউন্ড সিস্টেম, এহসান ট্যুর অ্যান্ড ট্রাভেলস, ইসলাম নিবাস প্রজেক্ট, এহসান পিরোজপুর হাসপাতাল, এহসান পিরোজপুর গবেষণাগার ও এহসান পিরোজপুর বৃদ্ধাশ্রম।

ভুক্তভোগীরা দাবি করেছেন, এসব প্রতিষ্ঠানের নামে অর্থ সংগ্রহ করে রাগীব পরিবারের সদস্য ও নিকট আত্মীয়দের নামে-বেনামে সম্পত্তি ও জায়গা জমি কিনেছেন।

গ্রেফতার রাগীব জিজ্ঞাসাবাদে র‌্যাবকে জানান, তিনি তার পরিবারের সদস্যদের নাম যুক্ত করে ব্যবসায়িক কাঠামো তৈরি করেন। শ্বশুরকে প্রতিষ্ঠানের সহসভাপতি, বাবাকে উপদেষ্টা, ভগ্নিপতিকে ম্যানেজার করেছেন রাগীব। এছাড়া রাগীব আহসানের তিন ভাইয়ের মধ্যে গ্রেফতার আবুল বাশার প্রতিষ্ঠানের সহ-পরিচালক। অন্য দুজন প্রতিষ্ঠানের সদস্য।

গ্রাহকদের কাছ থেকে সংগৃহীত অর্থ হাউজিং, ল্যান্ড প্রজেক্ট, ব্যবসায়িক দোকান, ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন সেবামূলক প্রতিষ্ঠানের আড়ালে আত্মসাৎ করেছেন রাগীব। তিনি এখন পর্যন্ত জিজ্ঞাসাবাদে ১১০ কোটি টাকা সংগ্রহের স্বীকারোক্তি দিয়েছেন।

গ্রেফতার রাগীব আহসান বিভিন্নভাবে গ্রাহকদের সাথে চেক জালিয়াতি করতেন। অনেকেই পাওনা টাকার চেক নিয়ে ব্যাংকে গিয়ে প্রতারিত হয়েছেন। এছাড়া, ভুক্তভোগীদের অনেকেই ভয়ভীতি, লাঞ্ছিত ও নির্যাতিত হওয়ার কথা জানিয়েছেন। তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন থানায় ১৫টি মামলা রয়েছে। এছাড়া, তার বিভিন্ন নির্যাতনের কাহিনী, মানববন্ধন, সংবাদ সম্মেলন ও গণমাধ্যমেও উঠে এসেছে।

এক প্রশ্নের জবাবে র‌্যাবের গণমাধ্যম শাখার প্রধান কমান্ডার মঈন বলেন, নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা তিনি সময়ে সময়ে গ্রাহকদের দিয়েছেন। তবে অধিকাংশ গ্রাহকই টাকা ফিরে পাননি। সাত থেকে আটটি ল্যান্ড প্রজেক্ট করেছেন, দুটি মার্কেট গড়েছেন।

এহসান গ্রুপের চেয়ারম্যান রাগীব এহসান ঠিক কত পরিমাণ অর্থ জালিয়াতি করেছেন তার বিশদ তদন্ত হওয়া প্রয়োজন। এক্ষেত্রে মানি লন্ডারিংও হতে পারে। সেজন্য সিআইডি ও দুদককে র‍্যাব চিঠি দিয়ে জানাবে।

হাতিয়ে নেওয়া অর্থ জঙ্গিবাদে কিংবা দেশকে উত্তপ্ত করার ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়েছে কি না জানতে চাইলে কমান্ডার মঈন বলেন, বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অবশ্যই বিষয়টি তদন্ত করে দেখবে। ঢাকা, সিলেট, নারায়ণগঞ্জ পিরোজপুরসহ ২০ জেলায় তার বিরুদ্ধে মানববন্ধন হয়েছে। তিনি যে পরিমাণ টাকা গ্রাহকদের কাছ থেকে হাতিয়েছেন, তা জঙ্গিবাদ বা দেশকে উত্তপ্ত করার ক্ষেত্রে ব্যবহার করতেন কি না তা তদন্তসাপেক্ষ।