Main Menu

রশীদ হায়দার : জীবনের গল্প শেষ হলেও…

১৩ অক্টোবর (২০২০) সকাল ৯টা ৫০ মিনিটে ঢাকা শহরে নিজ বাসায় ৭৯ বছর বয়সে জীবনের গল্প শেষ করে মহাপৃথিবী থেকে বিদায় নিলেন আমাদের প্রিয় লেখক রশীদ হায়দার (১৯৪১-২০২০)। ১৯৯৬ সালে যখন আমি বাংলা একাডেমি পরিচালিত তরুণ লেখক প্রকল্পের একজন প্রশিক্ষণার্থী তখন তিনি ৫৫ বছরের প্রাণবন্ত তরুণ। একাডেমির ভেতর এবং ঢাকার বাইরে কিংবা বিদেশের মাটিতে তাঁর কোনো শত্রু ছিল বলে আমার জানা নেই। তিনি ছিলেন লেখকদের বন্ধু, তিনি ঘিরে থাকতে পছন্দ করতেন তরুণদের দ্বারা। ধীর, স্থির কিন্তু তেজোদীপ্ত রশীদ হায়দার খুব সহজেই প্রথম পরিচয়ে মানুষকে আপন করে নিতে পারতেন। একাডেমি থেকে প্রকাশিত একাধিক পত্রিকার দায়িত্বে ছিলেন তিনি; অনেকের লেখা প্রকাশের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন সেসব পত্রিকায়। অনেককে নির্দেশনা দিয়ে লেখক হওয়ার পথ বাতলে দিয়েছিলেন তিনি। কথাসাহিত্যিক ইমদাদুল হক মিলনের জন্মদিনের ৬০ বছর পূর্তি উপলক্ষে হীরক জয়ন্তী উদযাপনের সময় কমিটির একজন কর্মী হিসেবে দেখেছি সেলিনা হোসেন, হাবীবুল্লাহ সিরাজী, কামাল চৌধুরী, বিশ্বজিৎ ঘোষ প্রমুখের সঙ্গে রশীদ হায়দারও উৎসাহী হয়ে কাজ করেছেন। নিজে লেখা দিয়ে সংবর্ধনা গ্রন্থ সমৃদ্ধ করে গেছেন। আমি নিজে তাঁর বাসায় গিয়েছি; সেই সূত্রে গাড়িতে গন্তব্যে পৌঁছানোর সময় তাঁর লেখার খবর নিতে পেরেছি। শেষ দিকে তিনি আর মিরপুরের বাসার বাইরে যেতে পারতেন না। কিন্তু তাঁর সঙ্গে দেখা করার ইচ্ছা আমার প্রবল ছিল। তাঁর চাওয়া-পাওয়ার পরিসর ছিল সীমিত। তিনি নির্লোভ ও মিতব্যয়ী ছিলেন।

রশীদ হায়দার ছিলেন বাংলা একাডেমির সাবেক পরিচালক, বাংলা একাডেমি পুরস্কার(১৯৮৪)এবং একুশে পদকপ্রাপ্ত(২০১৪) কথাসাহিত্যিক ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষক। রশীদ হায়দারের গল্প, উপন্যাস, নাটক, অনুবাদ, নিবন্ধ, স্মৃতিকথা ও সম্পাদনা মিলিয়ে ৭০-এর অধিক প্রকাশিত গ্রন্থ রয়েছে। পাবনা শহরে জন্মগ্রহণকারী মধ্যবিত্ত ঘরের এই দুলালের আসল নাম ছিল শেখ ফয়সাল আবদুর রশীদ মোহাম্মদ জিয়াউদ্দীন হায়দার। তাঁর বিখ্যাত ভাইয়েরা হলেন- নাট্যকার জিয়া হায়দার, কবি দাউদ হায়দার, কবি মাকিদ হায়দার, নাট্যকার আরিফ হায়দার।

মুক্তিযুদ্ধে স্বজন হারানো মানুষের স্মৃতিচারণা ১৩ খণ্ডের ‘স্মৃতি : ১৯৭১’ রশীদ হায়দারের শ্রেষ্ঠ কাজ। ১৯৬৭ সালের ১ জানুয়ারি প্রকাশিত হয় প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘‘নানকুর বোধি’’। ১৯৭২ সালে দৈনিক সংবাদ-এ ধারাবাহিকভাবে লেখা শুরু করেন জীবনের প্রথম উপন্যাস ‘‘গন্তব্যে’’। এটি উক্ত পত্রিকায় অর্ধেক মুদ্রিত হয়েছিল।মুনীর চৌধুরী এবং পরে জিয়া হায়দারের সূত্রে তিনি নাট্য জগতের সঙ্গেও নিজেকে জড়িয়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ ছিল রশীদ হায়দারের প্রিয় বিষয়। গবেষণা ছাড়াও তিনি গল্প-উপন্যাসে যুদ্ধের বাস্তবতা বারবার তুলে ধরেছেন।

২.

রশীদ হায়দারের ‘‘খাঁচায়’’ (১৯৭৫), ‘‘অন্ধ কথামালা’’(১৯৮১) এবং ‘‘নষ্ট জোছনা এ কোন অরণ্য’’(১৯৮২)-মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক এই ত্রয়ী উপন্যাসে যুদ্ধের ইতিহাসকে মানবজীবনের অঙ্গীভূত করে তোলার নিবিড় ঐকান্তিকতা খুঁজে পাওয়া যায়। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন যুদ্ধের প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন তিনি। পাকিস্তানিদের দ্বারা অবরুদ্ধ নগর জীবনের রূপকার হিসেবে বস্তুনিষ্ঠ। উপরন্তু মধ্যবিত্ত পরিবারের সংকট উন্মোচনে ভীষণ দরদী। একটি উদ্ধৃতি- ‘রাস্তাঘাট সব বন্ধ। … এই যে সামনে খোলা মীরপুর রোড, দক্ষিণ থেকে সোজা উত্তরে যাচ্ছে; কিন্তু আটকে গেছে মিরপুর ব্রিজের মুখে গিয়ে; সামনে পেছনে পাশে রয়েছে উদ্যত ভয়াবহ সঙ্গীণ। অথচ সেটা পার হতে পারলেই মুক্তি, প্রাণ ভরে নিঃশ্বাস নিতে পারার পূর্ণ অধিকার। রায়ের বাজার পার হয়ে নদী অতিক্রম করে ওপারে যেতে পারল চিৎকার করে বলা যায়, আমি আর পাকিস্তানিদের হাতের মুঠোয় নেই…। নারায়ণগঞ্জ দিয়ে কোথাও চলে যাওয়া যায় না? বাংলাদেশে কি তেমন ব্যক্তি নেই যে, এই খাঁচায় পোরা মানুষগুলিকে একটু আশ্রয় দিয়ে মুক্ত ও উদার দিগন্তে চলাফেরা করার সুযোগ দেবে না? ওদিক অবরুদ্ধ? বনানী গুলশান হয়ে? ক্যান্টনমেন্ট শিকার ধরার জন্য ছোঁক ছোঁক করে বেড়াচ্ছে ওখানে ধরা পড়লে এক খাঁচা থেকে আরেক খাঁচায়।’

তবে তাঁর ‘অন্ধ কথামালা’র পটভূমি গ্রামীণ জীবনে বিস্তৃত-বিশেষত নিজের জন্মভিটার আঙিনা পাবনার নিকটবর্তী এলাকার মুক্তিযুদ্ধের অভিঘাত চিত্রিত হয়েছে। গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা ও শান্তি বাহিনীর তৎপরতার কাহিনিতে দেখা যায় মুক্তিযোদ্ধাদের বিশ্বস্ত সহচর কীভাবে প্রলুব্ধ হয়ে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল- তবে তার কারণে মুক্তিযোদ্ধার মৃত্যু হলেও শত্রুমুক্ত দেশের স্বপ্ন লেখকের চেতনায় দীপ্ত-‘মানুষ অদৃশ্য হয়ে গেলেই সবকিছু শেষ হয়ে যায় না। মানুষকে দেখতে না-পেলেও মানতেই হবে সে আছে আশেপাশে, আশ পাশ থেকে একসময় বেরিয়ে বলবে, আমি নদীর তরঙ্গ দেখছিলাম, আমি কালকুলের নাচন প্রত্যক্ষ করছিলাম, আমি মোসলেম হোমিওর মেয়ে শরীফাকে দেখতে গিয়েছিলাম, আমি দেশের জন্য যুদ্ধে গিয়েছিলাম।’

‘অন্ধ কথামালা’র যুদ্ধ বাস্তবতার পরিসর চিত্রণের পর সেখান থেকে ভিন্ন মাত্রায় যুদ্ধোত্তর সময়ের রূপায়ণে ‘নষ্ট জোছনা এ কোন অরণ্য’ উপন্যাসটির দুটি অংশের বিন্যাসে রশীদ হায়দারকে আরো বেশি সাফল্য এনে দিয়েছে।মুক্তিযোদ্ধাদের হতাশা, কষ্ট, আদর্শচ্যুতি এবং একাত্তর পরবর্তী সামাজিক অবক্ষয় বিশেষত স্বাধীনতা বিরোধীদের উত্থানের ইতিহাসকে আখ্যানে স্থান দেওয়ায় প্রথম অংশের উপস্থাপন সত্যিই প্রশংসনীয়।সেখানকার একটি সংলাপ- ‘আর দুই এক বৎসর যাক, দেখবি মুক্তিযোদ্ধা বললে কর্তারা দেশদ্রোহী বলে আখ্যা দেবে।’ অন্যদিকে ‘এ কোন অরণ্য’ অংশে মুক্তিযোদ্ধাদের স্বীকৃতি আদায়ের প্রাণিত চিত্রণ রয়েছে। যেমন- ‘কোন অনুগ্রহই চায়নি হাতেম কেবল চেয়েছিলো ওরা বলুক আমারে গাঁয় ছাওয়াল হাতেম দ্যাশের জন্য যুদ্ধ করেছিলে।’ নিম্নবর্গ মানুষের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ন্যায্য মর্যাদা ও স্বীকৃতি আদায়ের যে চেষ্টা এ অংশে বর্ণিত হয়েছে তা প্রকৃতপক্ষে অনন্য।

৩.

রশীদ হায়দারের ছোটগল্প পাঠে আমার পর্যবেক্ষণ এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে। কথাসাহিত্যে তিনি আত্মপ্রকাশ করেন ছোটগল্পের গ্রন্থের মধ্য দিয়ে।আধুনিক গল্পকার হিসেবে তাঁর আবির্ভাব সময়ের ইতিহাসটি নিম্নরূপ।

মনে রাখতে হবে, চল্লিশ দশকেই পূর্ববাংলার কথাসাহিত্যে আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গীর উন্মেষ ঘটে। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ (১৯২২-৭১) ও শওকত ওসমান (১৯১৭-১৯৯৮) আমাদের প্রথম প্রকৃত আধুনিক গল্পকার। তবে আবু রুশদ, শামসুদ্দীন আবুল কালামও এ দশকেই খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। পরবর্তীকালে অসামান্য গল্প লিখে শরিক হন শাহেদ আলী, আবু ইসহাক, মিরজা আবদুল হাই প্রমুখ। পঞ্চাশ দশকে বাংলাদেশী ছোটগল্পের বিকাশের কাল। পূর্বোক্ত লেখকদের সঙ্গে যুক্ত হন সরদার জয়েনউদ্দীন, আলাউদ্দনি আল আজাদ, আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী, সৈয়দ শামসুল হক, হাসান হাফিজুর রহমান, বোরহান উদ্দিন খান জাহাঙ্গীর প্রমুখ। দেশজ জীবনবোধ ও প্রবল সমাজানুরাগকে আলিঙ্গন করে পঞ্চাশ দশকের গল্পকারদের অভিযাত্রা। জনৈক গবেষকের মতে, ‘‘তাঁদের গল্পের বিষয় যেমন দেশবিভাগ পূর্বকালের জীবনচিত্র রূপায়িত তেমনি আছে বিভাগ পরবর্তীকালের উদ্বাস্তু সমস্যা, মন্বন্তর, ক্ষুধা, দারিদ্র্য, দাঙ্গা ইত্যাদি নিয়ে তাঁরা গল্প লিখেছেন, তবে প্রাধান্য পেয়েছে বাংলাদেশের গ্রামজীবন, গ্রামের বা শহরের যে ধরনের বিষয় তখনকার গল্পকারেরা অবলম্বন করুন না কেনো, গল্পে যাপিত জীবনের সংকট ও সমস্যার আলেখ্যই তাঁরা রচনা করেছেন। কোনো কোনো শিল্পীর রচনায় শ্রেণী সংগ্রামও প্রমূর্ত হয়েছে।’’ একটু লক্ষ্য করলেই দেখা যাবে যে, পঞ্চাশ দশকেই কালের সংকট ও দেশীয় রাজনৈতিক পরিস্থিতি ছোটগল্পের বিষয়ে অঙ্গীকৃত হয়েছে। এ সময়ে ছোটগল্পের প্রকৌশল ও ভাষিকরীতি অধিকতর প্রাগ্রসর, অগ্রগামী ও তীক্ষ্ণ।

ষাটের দশকে এসে বাংলাদেশের ছোটগল্পের ধারায় একটি পালাবদল সংঘটিত হয়। পঞ্চাশ দশকের প্রথাগত ফ্রেমে গল্প রচনা ও জীবন অবলোকনের ক্ষেত্রে রোমান্সসুলভ দৃষ্টিভঙ্গী পাল্টে গেলো ষাট দশকে। অবশ্য বোধির নতুনযাত্রা সংযোজিত হলেও জীবনাবলোকের ক্ষেত্রে বৃহত্তর গ্রামীণ জীবন রয়ে গেলো এ দশকের গল্পের মূল স্রোতে বহমান। সীমিত নগরায়ন ও শিল্পায়নের ফলে নাগরিক জীবন ক্রমবিকশিত হলো এবং গ্রামীণ জীবনে নগরের রুচি ও সভ্যতার তরঙ্গ স্পর্শ করলো। অন্যদিকে পাকিস্তান আমলের অবরুদ্ধ সমাজচেতনা ও জটিলতম সমাজ গঠন এবং পাশ্চাত্য সাহিত্যরীতির ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্য আমাদের গল্পকারদের গ্রামীণ জীবন চিত্র অঙ্কনে সেই দৃষ্টিভঙ্গী প্রয়োগে উদ্বুদ্ধ করলো। এজন্যে অগ্রজ আলাউদ্দিন আল আজাদ, সৈয়দ শামসুল হক, শওকত ওসমানও এ দশকে সময়ের তরঙ্গ বিক্ষুব্ধ স্রোতের আলিঙ্গনে নতুনত্বের পরিব্রাজক। অবশ্য এ দশকেই অগ্রজ গল্পকারদের ক্ষীণ স্রোতের সঙ্গে সমীকৃত হয় নতুন প্রজন্মের ঝঞ্ঝা বিক্ষুব্ধ স্রোতধারা। নতুন প্রজন্মের মধ্যে জ্যোতি প্রকাশ দত্ত, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, রাহাত খান, আবদুল মান্নান সৈয়দ, সেলিনা হোসেন ও রশীদ হায়দার উল্লেখযোগ্য।

৪.

রশীদ হায়দার ষাটের অন্যান্য নতুন প্রজন্মের গল্পকারের মতই মধ্যবিত্তের অস্তিত্ব সংকট, চেতনালোকের নানাবিধ ক্ষরণ, গ্রামীণ জীবনের অসুস্থ জীবনাচার ও মূল্যবোধের টানাপোড়েনকে তাঁর গল্পে সুদক্ষ শিল্পীর কৌশলী বিন্যাসে উপস্থাপন করেছেন। তাঁর গল্প গ্রন্থগুলো বিষয় বৈচিত্র্যে অনন্য। জীবনের প্রতি প্রবল অনুরাগ, মানবিক সম্পর্কের জটিল অন্ধিসন্ধির জালভেদ ও মানবসমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা তাঁর গল্পে তীব্র মঙ্গলাকাঙ্ক্ষায় উৎসারিত। এছাড়াও মুক্তিযুদ্ধ তাঁর গল্পগ্রন্থের অন্যতম সার্থক প্রাপ্তি। ‘নানকুর বোধি’ (১৯৬৭), ‘অন্তরে ভিন্ন পুরুষ’ (১৯৭৩), ‘মেঘেদের ঘরবাড়ি’ (১৯৮২), ‘উত্তরকাল’ (১৯৮৭), ‘তখন’ (১৯৮৭), ‘আমার প্রেমের গল্প’ (১৯৮৮), ‘পূর্বাপর’ (১৯৯৩) প্রভৃতি গ্রন্থের গল্পমালা উক্ত মন্তব্যের সাক্ষ্য হিসেবে উপস্থাপনযোগ্য।

‘নানকুর বোধি’ (১৯৬৭) গ্রন্থে দশটি গল্প আছে। ‘‘নানকু’’, ‘‘আমি জুলেখা ও মা’’, ‘‘একটি সত্যি অথবা মিথ্যে গল্প’’, ‘‘কাক’’, ‘‘একটি অভদ্র ভদ্রলোক’’, ‘‘কামুকী’’, ‘‘বিধাতার দরবারে’’, ‘‘ধ্রুবতারার স্থানচ্যুতি’’, ‘‘ওরা যখন ঘুমে’’, ‘‘বোধি’’।

‘‘নানকু’’ গল্পটি বালক নানকু’র চাচা, দাদী ও অন্যানাদের সঙ্গে কুষ্টিয়ায় বিয়ে বাড়িতে যাবার সময় পদ্মায় ঝড় ও বিপদে পড়ে ডাকাত আছির বিশ্বাসের বাথানে আশ্রয়ের রাতের অভিজ্ঞতা ব্যক্ত হয়েছে। গল্পটিতে আসন্ন বিপদের টানটান উদ্বেগ আছে। আর আছে বালক নানকুর উক্ত রাতের অভিজ্ঞতার পরবর্তী প্রভাতের বর্ণনার গতিশীলতা- ‘‘তরাক করে লাফ দিয়ে উঠল নানকু, উঠেই এক লাফে ঘরের বাইরে এসেই দেখল, পূর্ব আকাশে মস্ত বড় সূর্য উঠেছে, সোনার রঙ সারা পৃথিবীতে যেনো চেয়ে গেছে। মুহূর্তে তার মনে হলো রাতের কথা, কিন্তু একটুও খারাপ লাগলো না, বরঞ্চ খুশিই হলো যেনো খুব খুশি, অসম্ভব রকমের খুশি। প্রচণ্ড ঝড়কে তার আশীর্বাদ মনে হলো, বাথানের ওই ঘরটায় যে ছেলে জন্ম হবে, সমস্ত আশীর্বাদ যেনো তার জন্যে।’’ (পৃ. ১৭)

‘‘একটি সত্যি অথবা মিথ্যে গল্প’’ পিতৃমাতৃহীন অসহায়, একদা আশ্রিত-পরিবার থেকে বিতাড়িত মেয়ের কাহিনি। এ গল্পে নারীর পথের অভিজ্ঞতা আছে; আরো আছে শহুরে মধ্যবিত্তের আশ্রয় প্রত্যাশীকে সাহায্য না করতে পারার সীমাবদ্ধতা। ‘‘কামুকী’’ গল্পের পাড়াগাঁয়ের বিধবা রাহেলা খাতুনের পুত্র-পুত্রবধূ থাকা সত্ত্বেও আরেকটি পতি গ্রহণের পরবর্তী জীবন এবং শেষ পরিণত চিত্রিত হয়েছে। বিধবা রাহেলা জীবনের নিঃসঙ্গ মুহূর্তগুলোতে ভালোবাসা, শান্তি ও স্বস্তি পেতে চেয়েছিলো কিন্তু দ্বিতীয় বিবাহের পরও তা পায়নি। তাই ‘‘রাহু ভাবী গায়ে কেরোসীন ঢেলে আগুন জ্বেলে মরে গেলেন। আমার চোখের সামনে স্পষ্ট আসছে; একটি অগ্নি প্রজ্বলিত দেহ, ঠোঁট দু’টি হাসি হাসি, কিন্তু সমগ্র বিশ্বের প্রতি এক অব্যক্ত ঘৃণায় কঠিন আকার ধারণ করেছে।’’ (পৃ. ৬৩)

‘‘বিধাতার দরবার’’-এ রশীদ হায়দার ফ্যান্টাসির জগতে পরিভ্রমণ করেছেন। অফিসের চেয়ারে ঘুমিয়ে স্বপ্নলোকে বিধাতার সাক্ষাৎ লাভ ও বিধাতার রসিকতার সঙ্গে সমাজের অসঙ্গতি প্রতীকায়িত। ‘‘ওরা যখন ঘুমে’’ গল্পে গ্রামীণ সমাজে হাজী হাছেন আলী সরদারের দ্বিতীয় বিবাহ ও প্রথম স্ত্রী খোদেজা খাতুনের নির্মম মৃত্যু রূপায়িত। খোদেজা যে স্বামীকে দীর্ঘ সংসার জীবনে শ্রদ্ধা ও ভক্তির সঙ্গে গ্রহণ করেছিলো তাকে শেষে মনে হয়- ‘‘এখন তাঁর দ্বিতীয়বার সদ্য বিবাহিত প্রৌঢ় স্বামীর সামনে বসে তাঁর বোধ হতে লাগলো, লণ্ঠনের আলো গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে বাতাসে উড়ে যাচ্ছে, আলোর উজ্জ্বলতা এক সময় ম্লান হয়ে কালো রং ধরলো। জীবনের যে সমস্ত দিন অতীতে আশ্রয় নিয়েছে, তার মধ্যে তিনি এই মুহূর্তে গভীরভাবে ডুবে যেতে চাইলেন। কিন্তু দেখলেন অন্ধকার, শুধুই অন্ধকার।’’ (পৃ. ৮৬)

‘‘বোধি’’ লেখকের ব্যক্তিগত জীবনে ছোটভাইকে হারানোর এক বেদনামথিত হৃদয়ের গল্প। টেলিগ্রাম পেয়ে ঢাকা থেকে গ্রামের বাড়িতে যাবার বর্ণনা রয়েছে এতে। আরো রয়েছে যাত্রাপথে লেখকের অন্তর্জগতের নানা প্রসঙ্গ।

প্রেম সংক্রান্ত অভিব্যক্তির প্রকাশ রয়েছে ‘‘আমি জুলেখা ও মা’’, ‘‘কাক’’, ‘‘একটি অভদ্র ভদ্রলোক’’, ‘‘ধ্রুব তারার স্থানচ্যুতি’’ ইত্যাদি গল্পে। ‘‘আমি জুলেহা ও মা’’, ‘‘একটি অভদ্র ভদ্রলোক’’ গল্প দু’টিতে উত্তম পুরুষের ভঙ্গি রয়েছে। অন্যদিকে অপর দু’টি গল্পে ব্যর্থ প্রেমিকের প্রতিশোধ স্পৃহার প্রকাশ সহজ সরল ভাষাভঙ্গিতে রাবীন্দ্রিক গতিময়তা লক্ষণীয়-‘‘অথচ বিকেলে আকাশে মেঘ করেছিলো। কেউ লক্ষ্য করেনি সে মেঘের আকস্মিক আবির্ভাব; যেনো সকলে হঠাৎ করেই আবিষ্কার করল, আকাশ কালো বসনে নিজেকে আবৃত করেছে শোক করে অশ্রু ঝরাবে বলে।

কিন্তু আকাশের অশ্রু ঝরলো না, মুখ গোমরা করে রইলো সেই সন্ধ্যে থেকে; এখন গভীর রাত; তবুও সে মুখ খুলল না।’’ (পৃ. ৭২)

স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে শহরকে কেন্দ্র করে যে চাকরিজীবী মধ্যবিত্ত শ্রেণীর উদ্ভব হয়েছে তাদের জীবন-যাপন প্রণালী, তাদের আশাভঙ্গের কাহিনি, আর্থিক টানাপোড়েন, মূল্যবোধের বিপর্যয়, ব্যক্তিত্বের সংকট, সুখ-দুঃখ, প্রেম অভিমান ইত্যাদি বিষয়গুলো রশীদ হায়দারের ‘অন্তরে ভিন্ন পুরুষ’ (১৯৭৩) ও ‘মেঘেদের ঘরবাড়ি’ (১৯৮২) গল্পগ্রন্থের গল্পগুলিতে অভিব্যক্ত হয়েছে।

‘অন্তরে ভিন্ন পুরুষ’গল্পগ্রন্থের ‘‘অচেনা’’ গল্পে স্ত্রী বিয়োগের পর ইউসুফ সাহেবের নাগরিক জীবনের নিঃসঙ্গ ক্রন্দন রূপায়িত। মাতৃহীন পুত্র শুভকে পিতৃ স্নেহে মানুষ করে বিবাহ দিয়েছেন ইউসুফ সাহেব। কিন্তু নিজে অন্তর্জগতের কামনায় উদবেলিত হয়ে উঠেছেন। এমনি একদিন রাতে ইউসূফ সাহেব পুত্র ও পুত্রবধুর মিলন দৃশ্য দেখতে গিয়ে পুত্রের হাতে ধরা পড়েন। ‘‘পরবর্তী সকাল থেকে ইউসূফ সাহেবকে আর কোথাও দ্যাখা যায়নি।’’ (পৃ. ১৪)

‘‘পলাতক’’ গল্পে মতিন সাহেবর হীন অর্থনৈতিক অবস্থার প্রেক্ষাপটে সাংসারিক সম্পর্কের শীতলতা মনোজগতের চিন্তায় বিধৃত হয়েছে। একইসঙ্গে বাস্তব প্রতিবেশের তুচ্ছতা ঘিরে রেখেছে গল্পের অবয়ব। ‘‘আত্মপক্ষ’’-এ শিক্ষিত মধ্যবিত্ত তারেক আলী অফিসে বড়বাবুর কাছে মানসিক লাঞ্ছনা ভোগের পরে বাসায় ফিরে ঘটনাক্রমে ছোটভাইকে প্রহার করার পরবর্তী মানসিক অবস্থার অভিব্যক্তি বিধৃত করেছেন রশীদ হায়দার। অন্যদিকে ‘‘জয়’’ গল্পটিতে আশ্রিত, বিএ পরীক্ষার্থী, দরিদ্র যুবক নুরু’র সঙ্গে অফিস ফেরত আশ্রয়দাতা মাহবুব সাহেবের পারস্পরিক সম্পর্কের নাটকীয় পরিসমাপ্তি লক্ষণীয়। মাহবুব নুরুর সঙ্গে তাস খেলতে বসে ক্রমান্বয়ে পরাজিত হতে থাকলে নুরুর প্রতি তার আক্রোশ তীব্র থেকে তীব্রতর হয় এবং এক পর্যায় ঝাঁপিয়ে পড়ে নুরুকে হত্যা করে মাহবুব সাহেব। গল্পটিতে মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ আছে, আছে ভাষায় তীর্যক, ক্ষীপ্রগতি।

‘‘চোর’’ আবদুল আজিজের স্ত্রীর সঙ্গে গহনা সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে প্রতারণা করতে গিয়ে ধরা পড়ার গল্প। বিবাহের গহনা আবদুল আজিজ মূলত বন্ধু হাসেমের কাছ থেকে শর্ত সাপেক্ষে চেয়ে এনেছিলো। শর্ত ছিলো বিবাহের পর এগুলো ফেরত দেবে। কিন্তু স্ত্রীর মনে আঘাত না দেবার জন্য সে কৌশলে চুরির ঘটনা সাজায়। অথচ দুর্ভাগ্য তার এই যে শেষ পর্যন্ত স্ত্রীর হাতে আজিজ ধরা পড়ে এবং সতা ঘটনা উদঘাটিত হয়।

‘‘মাত্রা’’ ও ‘‘স্বাদ’’ দু’টি গল্পেই প্রেমের ব্যর্থতা বর্ণিত হয়েছে। ‘‘মাত্রা’’ গল্পে তারেক-হাসিনার প্রেমে দৈহিক মিলনের বিবরণ আছে কিন্তু দৈহিকতা সর্বস্ব তারেক হাসিনার কাছে শেষ পর্যন্ত হার মেনেছে। কারণ তারেক মাত্রা ছাড়িয়ে গিয়েছিলো। তাদের কথোপকথনের কিছু অংশ নিম্নরূপ-

‘‘তুমি আমাদের বাসায় আসো কেনো ? তুমি জানো, তোমার আসাটা কেউ বড় একটা পছন্দ করে না ?

না জানি না। জানো না, জেনে রাখো। তোমার সঙ্গে আমার বিয়ে হবে এ জন্যে কেউ কিছু না বললেও তুমি যে আচরণ করছো, কেউ দেখে ফেললে তুমি কি ভেবেছো সেটা সহজভাবেই নেবে।

না।

তাহলে ? মাত্রাটা ছাড়িয়ে যাচ্ছে, এটা যেনো খেয়াল থাকে।

আমার ভুল হয়েছে।

ভুল হবে কেনো ? আর কিছু ভুল হয় না, এটা ভুল হয় কেনো ?

আমি দুঃখিত।

আমিও দুঃখিত।

আমিও দুঃখিত হবো, ভবিষ্যতে যদি এই ভুল আবারও হয়। এখন যাও।’’(পৃ. ৪৫)

‘‘স্বাদ’’ গল্পটিতে মুক্তিযুদ্ধের আবহ আছে এবং একইসঙ্গে আছে আসাদ-নাজমার ব্যর্থ প্রেমের দীর্ঘনিঃশ্বাস। রবীন্দ্রনাথের ‘‘একরাত্রি’’র নায়কের মতোই আসাদ সুযোগ পেয়েছিলো আগরতলায় স্বামীর কাছে পৌঁছে দেবার সময় নাজমার সঙ্গে মিলিত হবার। কিন্তু তা সম্ভব হয়নি তখন। পৌঁছে দিয়েছিলো নাজমাকে তার স্বামীর কাছে। কিন্তু নাজমার পিতাকে জানিয়েছিলো যে, মিলিটারি তার মেয়েকে ধরে নিয়ে গেছে। গল্পটিতে সূক্ষ্ণ পরিহাস আছে। সূচনাংশ স্মরণীয়-‘‘বলতে পারেন, আমার খুশি চরিতার্থ করার জন্যে একটা পরিবারে কান্নার রোল পড়ে গেলো, চিন্তা, উদ্বেগ আর ভয়ে মানুষগুলো মুহূর্তে আধমরা হয়ে গেলো, সেখানে নিশ্চয়ই আমার ইচ্ছা অনিচ্ছাই বড় নয়। সে ক্ষেত্রে আমি বলবো-ওটা আমার খুশি।’’ (পৃ. ৯৯)

৫.

‘মেঘেদের ঘরবাড়ি’ (১৯৮২) গল্পগ্রন্থের গল্পগুলোতে অবক্ষয়িত সমাজের নানা প্রসঙ্গ রূপায়িত। ‘‘বাজিকর’’ গল্পে যেমন রূপকথার প্রসঙ্গে রশীদ হায়দার রোমান্টিক বর্ণনায় আত্মমগ্ন, তেমনি ‘‘নষ্ট’’ গল্পে দীর্ঘদিন পর প্রেমিকার সঙ্গে পুনরায় সাক্ষাতের নাটকীয় ঘটনা উপস্থাপনায় তিনি বাস্তব অন্বেষী। ‘‘তেলেস্মা’’ গল্পে আছে উদ্ভট চিন্তাকে কার্যকরী করার ব্যর্থ প্রয়াস। অন্যদিকে ‘‘দু’জনে’’ গল্পে মুক্তিযুদ্ধের অনুষঙ্গে ফার্মের অফিসের দুই মহিলা কর্মচারির স্বামীর দীর্ঘদিনের অনুপস্থিতির স্মৃতি রোমন্থনের নাটকীয় পরিণতি বর্ণিত।

‘‘সেই যাত্রা’’ গল্পে পিতৃবিয়োগের সংবাদ পেয়ে পুত্রের গ্রামের যাবার প্রস্তুতি যাত্রা ও পৌঁছানোর বিবরণ বিধৃত। ‘‘মধ্যরাতে টোকা’’ সমকালের রাজনৈতিক সংকটের চিত্র। ‘‘তেল’’ গল্পটিতে একদিকে সমকালীন প্রসঙ্গ অন্যদিকে স্বার্থপর, আত্মকেন্দ্রিক পরিবারের তেল সংকটের চিত্র অঙ্কিত। হাবিব সাহেবের নীচতলায় বাড়িওয়ালার তেলের ডিলার গ্রহণ ও তেল বিতরণের দিন তেল চুরির দায়ে জনতার বাড়িওয়ালার গৃহ আক্রমণের এক পর্যায় আবুল হোসেনের অফিস থেকে সংগৃহীত তিন টিন তেল লুণ্ঠনের কাহিনির সঙ্গে মধ্যবিত্ত গৃহিণী মরিয়মের জনগণ বিযুক্ততা আভাসিত হয়েছে। ‘‘সেই প্রেম’’ গল্পে ক্ষণস্থায়ী প্রবাসী জীবনে শফি সাহেবের পুরানো প্রেমিকার সাক্ষাৎ ও সে সঙ্গে প্রাসঙ্গিক ভাবনার বিস্তারিত বিবরণ বর্ণিত।

ছোট ভাইয়ের মৃত্যুকে গল্প লেখার উপাদান করেছেন বড় ভাই। অন্যদিকে পিতা এর বিরোধী। পিতা-পুত্রের পারস্পরিক সম্পর্কের মতদ্বৈততা ‘‘ঘাতক’’ গল্পে রূপায়িত। পিতৃআজ্ঞা অমান্য করে নিজস্ব বোধে চলার অঙ্গীকার জ্ঞাপনই ঘাতকপুত্রের অভিপ্রায়। ‘আমার পক্ষে ধৈর্য রাখা সম্ভব হয়নি। সম্ভব অসম্ভব যা মুখে এলো তাই বললাম। আমাকে একটিবার ইচ্ছে করেও থামতে দেইনি। উত্তেজনার চরম মুহূর্তে আমি জ্ঞান হারাইনি বলে খেয়াল করলাম আমার পিতা ছুরিকাহত হয়েছেন। আমি তাঁর সন্তান, তাঁর বুকে যেনো ছুরি মেরেছি। তিনি আমাদের মাঝে তাঁকে দেখতে চেয়েছিলেন, তার প্রতিদানে আমি পিতার আজন্মলালিত জীবনদর্শনের ওপর এমন কটু মন্তব্য করলাম যা তীক্ষ্ণ ছুরির মতোই তাঁর বুকে গিয়ে বিধেছে।’’ (পৃ. ১২১)

‘‘বৃহন্নলা’’ গল্পে স্বাধীনতার বিরোধী শক্তির নাজেহাল অবস্থা বর্ণিত। জনৈক আলতাফের বাসায় প্রবেশের পর চোর শেষ পর্যন্ত আবিষ্কার করে যে আলতাফ নপুংসক। এই গল্পে প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত বর্ণনায় দ্রুততা ও উদ্বেগের পরাম্পর্য সংগ্রথিত।

৬.

মুক্তিযুদ্ধ কেন্দ্রিক গল্প রশীদ হায়দারের ছোটগল্পের একটি বিশেষ দিক। এক্ষেত্রে লেখকের সামাজিক দায়-দায়িত্ব খুব বেশি সোচ্চার। কারণ মুক্তিযুদ্ধের পরে দেখা গেছে ‘‘সমাজপ্রবাহের নানা ভাঙ্গা-গড়া হয়েছে, রাজনৈতিক প্রক্রিয়ারও পরিবর্তন হয়েছে। শোষণ আর বঞ্চনা আগের তুলনায় বেড়ে গিয়েছে এবং সাধারণ মানুষের কোনো অর্থনৈতিক মুক্তি ঘটেনি। এর মধ্যে গজিয়ে উঠেছে স্ফীতকায় একটি উচ্চবিত্ত শ্রেণি যার জীবনাযাপনের কেন্দ্র ঢাকা-চট্টগ্রাম প্রভৃতি বড়ো বড়ো শহর। এই শহরবাসিদের সঙ্গে গ্রামের অখণ্ড সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন ফলে দারিদ্র্যক্লিষ্ট গ্রামীণ সমাজে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদীপ্ত হবার প্রেররা স্বতঃস্ফূর্ত নয়। অন্যদিকে একাত্তরে শোষিত ও পীড়িত মানুষের যে অংশটি যুদ্ধ জয়ের নেশায় ছিলো তারাও বিপর্যস্ত নানা করাণে।’’ মানুষের দৃষ্টিতে এসেছে রাজাকারদের সমাজপতি হবার কৌশল, ঘাতকদের অধিষ্ঠান। ফলে আশাহত মানুষের নানা অনুষঙ্গ মুক্তিযুদ্ধ কেন্দ্রিক গল্পগুচ্ছের প্রাণ।

রশীদ হায়দারের ‘উত্তর কাল’ (১৯৮৭) এবং ‘তখন’ (১৯৮৭) মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক গল্পগ্রন্থ। উত্তরকালের ‘‘এ কোন ঠিকানা’’, ‘‘সেই পাখীর গান’’, ‘‘এ কোন গৃহকোণ’’, ‘‘সাঁকো’’, ‘‘কল্যাণপুর’’, ‘‘চেহারা’’ প্রভৃতি গল্পের ভেতর ‘‘এ কোন ঠিকানা’’, ‘‘চেহারা’’ গল্প দু’টিতে লেখকের ডায়রিসুলভ পরিচর্যা লক্ষণীয়। মৌখিক কথোপকথনের ভঙ্গি কিংবা সর্বজ্ঞ লেখকের বর্ণনা এসব গল্পে প্রাধান্য পেয়েছে।

‘‘কোন ঠিকানা’’ গল্পের বর্ণনায় তির্যকতা, নাটকীয়তা ও তীক্ষ্ণগতি আছে। আছে রাজাকারের ভূমিকা অবলম্বনকারী নান্টুর ঘনিষ্ঠ বন্ধু মুক্তিযোদ্ধা ও পত্র লেখক বাসেতের ভাই মাজেদকে নির্মমভাবে হত্যার ইঙ্গিতময় বিবরণ। লেখকের এই পত্র জীবন্ত হয়ে উঠেছে ঘটনার সুনিপুণ চয়নে। অতীতের যুদ্ধস্মৃতির রোমন্থন এবং নান্টুর ভূমিকা উন্মোচনে ‘‘এ কোন ঠিকানা’’ অনন্য। যেমন-‘‘কয়েক বছর পর আবার দু’জনের দেখা হয়েছিলো। তিনদিন আগে, এখানেই। সেখানেই বাসেত তার বড়ো ভাই মাজেদের বন্ধু নান্টু ভাইকে প্রস্তাবটি দেয়। নান্টু ভাই সেটি গ্রহণ করলো। ‘‘আপনার যাতে আমার বাসা খুঁজে পেতে বিন্দুমাত্র কষ্ট না হয় সে জন্যেই একটু বিশদ বিবরণ দেবো।’’ (পৃ. ৯)

‘‘সেই পাখির গানে’’ শহুরে পাঁচ বন্ধু অবসর কাটানোর উদ্দেশ্যে গ্রামীণ পরিবেশে ভ্রমণে গিয়ে ছিলো একটি নতুন পাখির গান শুনতে, কিন্তু সেই পঞ্চবন্ধু গ্রামের প্রান্তে অড়ল ডালের ক্ষেতের পার্শ্বে সাক্ষাত পেয়েছিলো ফাতুর মা’র। যুদ্ধ এসে কিভাবে ফাতুর মা’র সাজানো সংসার ভেঙে দিয়েছিলো সেই কাহিনি শুনে পাঁচবন্ধু সে দিন ফিরেছিলো। তারা ফিরেছিলো মূলত ফাতুর মা’র করুণ বিলাপের গান শুনে। গল্পটিতে পাখির গানের প্রতীকী বিন্যাস আকর্ষণীয় মনে হয়েছে। যে পাখি নিজের নীড় বেঁধেছিলো, তার সাধের নীড় ভাঙার কাহিনিই মুক্তিযুদ্ধের আবহে বিন্যস্ত।

জমিলার সঙ্গে প্রেমের প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়িয়েছিলো তার ভাই। জমিলাও যে প্রেমে স্বীকৃতি দিয়েছিলো এমন নয়। কিন্তু প্রতিশোধ স্পৃহা জেগেছিলো নায়কের মনে। সেই নায়ক মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীশক্তির রূপক। শেষ পর্যন্ত নিজের আয়ত্তে পেয়ে জমিলাকে নিয়ে সে পাশবিক হতে চেয়েছে। কিন্তু কোথাও যেনো তার অপূর্ণতা ছিলো। তাই সে শেষে পিপাসার্ত হয়ে চমকে গেছে-‘‘সাঁকো’’ গল্পের মূল বিষয় এই। গল্পটিতে খল নায়কের কথনভঙ্গি প্রাধান্য পেয়েছে। ‘‘কল্যাণপুর’’ গল্পে মুক্তিযোদ্ধার অবচেতনে স্বাধীন দেশের ঘাতকদের আতঙ্ক রূপায়িত হয়েছে। ‘‘চেহারা’’ গল্পে মজনু’র বোনকে মুক্তিযুদ্ধের সময় মিলিটারির হাত থেকে রক্ষার জন্য তার পিতার আগুনে মুখ ঝলসে দেবার গল্প রয়েছে এবং স্বাধীনদেশে সেই নারীর বিবাহ না হবার করুণ কাহিনি নাটকীয় বিপ্রতীপ ভঙ্গিতে শেষ হবার ইঙ্গিত আছে।

‘উত্তরকালে’র মতোই ‘তখন’ গল্পগ্রন্থে একাত্তরের স্মৃতি বিজড়িত কাহিনি বিন্যাস লক্ষ্ করা যায়। ‘‘প্রথম দিনে’’, ‘‘এ কোন সঙ্গীত’’, ‘‘হওয়ার মানুষ’’, ‘‘নিয়মের নিয়ামত বুড়ো’’, ‘‘দ্বিতীয়বার’’, ‘‘বিপদের ঘ্রাণ’’- এই ছয়টি গল্প নিয়ে এই গ্রন্থটি রচিত।

‘‘প্রথম দিনে’’ গল্পে যুদ্ধে অবরুদ্ধ ঢাকাবাসী বাদশার মা’র সন্তান বাৎসল্য-উৎকণ্ঠা প্রকাশিত। ‘‘এ কোন সঙ্গীতে’’ রয়েছে গ্রামের বাড়িতে দু’মাস ছ’দিন পর প্রত্যাবর্তনকারীর ও যুদ্ধ আতঙ্কগ্রস্ত গ্রামীণ মানুষের মধ্যে নিযামের অন্তরজগতের ভীতিবোধ। ‘‘হাওয়ার মানুষ’’ গল্পে মিলিটারি কর্তৃক আক্রমণে গ্রামীণ জীবনে ক্ষুদ্র ওসমান পাগলের মৃত্যুকে আলম আবিষ্কার করে ‘‘ওসমানের’’ অস্বাভাবিক মৃত্যুটা আপনজন নয় বলে কারো মাথায় আসেনি। (পৃ. ৮৬) আলমকে বাড়ির মানুষ রিপোর্টিং ভঙ্গিতে সংবাদ জ্ঞাপনের সময় গল্পে আতঙ্ক শিহরিত আবহ সৃষ্টি হয়েছে।

অন্যদিকে ‘‘নিয়মের নিয়ামত বুড়ো’’ দীর্ঘ উপন্যাসোপম বিবরণধর্মী গল্প। এতে নিয়ামত বুড়োর দৈনন্দিন কার্যক্রমের ব্যত্যয় অভিব্যক্ত হয়েছে। কিভাবে প্রাথমিক পর্যায়ে নিয়ামতের যৌবনের স্রোতে ধর্মকর্ম মুছে গিয়ে প্রকৃতির সান্নিধ্যে গ্রামীণ মানুষ হয়ে উঠেছিলো এবং শেষে যুদ্ধের ঘটনায় বার্ধক্যে নিয়ামত কিভাবে পূর্বের সব নিয়ম আবার মুছে ফেলতে চেয়েছিলো অতুল প্রাণশক্তির প্রদীপ্তে, তারই আনুপূর্বিক বর্ণনা রয়েছে ‘‘নিয়মের নিয়ামত বুড়ো’’ গল্পে। এই গল্পের ভাষায় আছে গীতলতা ও পরিচর্যায় রয়েছে চিত্রকল্পের ব্যবহার। যেমন-‘‘সহসা তাহের উদ্দিনের অস্থিরতার কথা মনে হওয়ায় সে সামনে তাকিয়ে দেখলো রোদের তাপে রাস্তা দিয়ে তাপ উঠছে, সবকিছু দুলছে চোখের সামনে।’’ (পৃ. ৭১) অন্যত্র-‘‘পাকিস্তানের কথা থেকে মুজিবরের কথায় আসতে আসতেই মালেকের এই পরিবর্তনে নিয়ামত ভয়ে ভেতরে ভেতরে আষাঢ়ের চড়চড়ে রোদে জমি ফাটার মতো ফাটতে থাকে।’’ (পৃ. ৬৭)

‘‘দ্বিতীয়বার’’ পাকসেনার আক্রমণ থেকে পলায়নপর, চরে আশ্রিত স্বামী-স্ত্রীর ও কন্যার করুণ পরিণতির গল্প। উৎকণ্ঠ ও ভীতিবোধ থেকে অপ্রত্যাশিতভাবে কন্যার কণ্ঠস্বর নিবৃত্ত করতে গিয়ে মৃত্যু ঘটে শিশু রত্নার। ফলে শত্রুমুক্ত গৃহে ফিরে স্ত্রী মস্তিষ্ক বিকৃতিতে মৃত্যুবরণ ও স্বামী গৃহ থেকে অনিকেত উদ্দেশ্যে যাত্রা করে। ‘‘বিপদের ঘ্রাণ’’ গল্পে মুক্তিযুদ্ধের সময় আত্মপরিচয় গোপনকারী ফেরিযাত্রী আফজালের স্ত্রী দোলনসহ যাত্রাপথে ‘‘দোলনের প্রাক্তন প্রেমিক বোরহানের সঙ্গে আতঙ্ক শিহরিত সময় নির্বাহ ও নাটকীয় পরিণতি চিত্রিত। বোরহানের প্রতি দোলনের শেষ ব্যবহার নিষ্ঠুর, স্বার্থপর নারীর পরিচয় জ্ঞাপক-‘‘দোলন সঙ্গে সঙ্গে অন্যদিকে ঘাড় ঘুরিয়ে বাতাস কেটে কেটে চাপা গলায় জবাব দেয়, খামোহা ও সব বোঝা বাড়িয়ে লাভ নেই।’’ (পৃ. ১০৬)

আলোচ্য মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক গল্পগুলোতে রশীদ হায়দারের গ্রামীণ জীবন ও সমাজের প্রতি এক ধরনের আকর্ষণ লক্ষ করা যায়। কিন্তু গ্রামীণ জীবনের উন্মূলিত মানুষের রূপায়ণ নেই; জীবনের সুস্থ দিকের প্রতি লেখকের দৃষ্টি, অসুস্থ, কুৎসিত দিকে নয়।

রশীদ হায়দারের আরেকটি গল্পগ্রন্থ ‘‘পূর্বাপরে’’র পূর্বে ‘‘আমার প্রেমের গল্প’’ (১৯৮৮) শীর্ষক গ্রন্থের দু’টি গল্প আলোচনাযোগ্য। কারণ এতে সংকলিত ‘‘কাক’’, ‘‘আমি, জুলেহা ও মা’’, ‘‘মাত্র’’, ‘‘স্বাদ’’, ‘‘সেই প্রেম’’, ‘‘সাঁকো’’, ‘‘বিপদের ঘ্রাণ’’, ‘‘নষ্ট’’ প্রভৃতি পূর্বে প্রকাশিত গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত গল্পমালা। এ জন্য নতুন গল্প ‘‘উৎসব’’ এবং ‘‘লাবণ্য, লাবণ্যময়ী’’ শীর্ষক গল্পদুটি এ ক্ষেত্রে আলোচ্য।

‘‘উৎসব’’ গল্পে জীবনে দুর্দান্ত ফুটবল খেলোয়াড় সরোজের অপঘাতে মৃত্যুর কাহিনির সঙ্গে সরোজের বোন সরমা নজরুলের অসম প্রেমের পরিণতি রূপায়িত, কথকের ভঙ্গিতে। গল্পটির বুনন অনিবার্য গতিবেগ দান করেছে। একটি অংশ স্মরণীয়- ‘‘বলতে চাই না নজরুল; তারপর সব জানিনে জানার প্রয়োজন ফুরিয়ে গিয়েছিলো। সরোজের মৃত্যুর পর ওদের বাড়িতে আবার রান্নার চুলো জ্বলেছে; ওর বাবা আবার গাউন চাপিয়ে কোর্টে গেছে, সরমা বেনী বেঁধে স্কুলে গেছে, ওর মা চকচকে কাঁসার কলস নিয়ে বাড়ির পাশের পুকুর থেকে পানি আনতে গেছে, আমরা স্কুলে গেছি, পরীক্ষা দিয়েছি, হেডমাষ্টার কোচোয়ান বলে বকাবকি করে গেছেন, কিছুই থেমে থাকেনি। কেবল তুমি ছিলে আমাদের আড়ালে, সরোজ ছিলো জীবনের, জানার চেষ্টা করিনি কে কোথায় কেমন আছে।’’ (পৃ. ১১০)

‘‘লাবণ্য, লাবণ্যময়ী’’ গল্পে টেলিফোন আলাপচারিতার স্বপ্নময়ী নারী শেষ পর্যন্ত বাস্তবে ধরা দেয়নি বলে কথকের আক্ষেপ প্রকাশ পেয়েছে। এতে গল্পের অংশ কম।

‘‘জাতিতত্ত্ব’’, ‘‘বাবার দ্বিতীয় গল্প’’, ‘‘ব্যবধান শূন্য’’, ‘‘হাওয়ার বাঁক বদল’’, ‘‘স্বর্গলোক’’, ‘‘আপনজন’’, ‘‘মর্ত্যলোক’’, ‘‘আজ অনামিকা’’- এই আটটি গল্প নিয়ে ‘পূর্বাপর’গ্রন্থ (১৯৯৩) সংকলিত।

সাম্প্রদায়িক সমস্যা নিয়ে ‘‘জাতিতত্ত্ব’’ রচিত। এর অভ্যন্তরে রয়েছে সনাতন ধর্মাবলম্বী দীপিকার সঙ্গে আলমের বিবাহ এবং দাঙ্গা পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়ে দীপিকার ছাত্র শফিকের তাঁর গৃহে আশ্রয় গ্রহণ ও দাঙ্গাবাজ লোক কর্তৃক শফিককে হিন্দু সন্দেহে আক্রমণে উদ্যত মুহূর্তে অধ্যাপিকা দীপিকার প্রতিরোধ প্রভৃতি অনুষঙ্গ। মুক্তিযুদ্ধের অবক্ষয়িত চেতনার বিরুদ্ধে পিতার উপহাস ‘‘বাবার দ্বিতীয় গল্পে’’ অভিব্যঞ্জিত। বাবার শেষ সংলাপ স্মরণীয়- ‘‘ইয়েস হ্যাঁ তাই। নইলে ষ্টুপিড বয়, শুনে রাখো, লোকে খোদ যুদ্ধের কথাই যেখানে ভুলে গেছে, সেখানে পাগল-ছাগলদের কথাই তো মনে থাকবে। -থুঃ থুঃ।’’ (পৃ. ২৭)

মুক্তিযুদ্ধে স্বামীহারা স্ত্রী সুশীলা ধর্মগত বিভেদের জন্য আশ্রয়চ্যুত; উন্মূলিত হওয়ার ইঙ্গিতময় কাহিনি ‘‘ব্যবধান শূন্যে’’ রূপায়িত হয়েছে। অন্যদিকে, ‘‘হাওয়ার বাঁক বদল’’ গল্পে জনৈক আজিমের মা’র মৃত্যু সংবাদ পাওয়া সত্ত্বেও গ্রামে প্রত্যাবর্তন না করে স্ত্রীকে সেখানে পাঠিয়ে দিয়ে নবনির্মিত যুবকদের মুক্তিযুদ্ধ সংগঠনে নেতৃত্ব দেবার লোভে ও পূর্বের মুক্তিযুদ্ধ কার্যকলাপ স্মরণে একাকী আজিমের অনুশোচনার মধ্যে দিয়ে গল্পটি শেষ হয়েছে। এ গল্পটিতে অধুনা বাংলাদেশের সমাজে নতুন লেবেল আটা মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে ব্যঙ্গ করা হয়েছে। ‘‘স্বর্গলোক’’ গল্পে বাস্তবের সরাসরি উপস্থাপন নেই আছে উত্তম পুরুষের জবানিতে রাজবাড়ির নিমন্ত্রণ ত্যাগ করে প্রেমিকার সঙ্গে প্রণয়-উপাসনার কাহিনি। একইসঙ্গে জনৈক ব্যক্তির বুকে-পিঠে লিখিত স্লোগানে রাজপথে বিচরণের সময় প্রেমিক-প্রেমিকাসহ তিনজন গ্রেফতার হলে রাজদরবারে রাজার বিচার কার্যের মধ্যে যে হাস্যরস সৃষ্টি হয়েছে তাই-ই এ গল্পের টেকনিকের অন্যতম প্রান্ত। গল্পটির অন্তরধর্মে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে নূর হোসেনের আত্মদানের প্রতিচ্ছবি চিত্রিত হয়েছে। অন্যদিকে ‘‘আপনজন’’ গল্পে মধ্যবিত্ত শহুরে পড়ুয়া ওসমানের আত্মমর্যাদাবোধ চিত্রিত হয়েছে। কুলখানিতে গিয়ে ওসমান পিতৃঘাতক রাজাকার আবুবকর মেম্বারের সন্তানের কাছ থেকে খাদ্যের প্যাকেট না নিয়ে বরং দৃঢ় কণ্ঠে বলেছে- ‘‘আমি কুলখানির খাবার খাইনে।’’ (পৃ. ৮৩)

‘‘স্বর্গলোকে’’র বিপরীত ‘‘মর্ত্যলোক’’ গল্পে আনন্দ-অনামিকার সুদীর্ঘ দিনের পর পুনরায় ফেরিতে সাক্ষাতের বিবরণ আছে, যে ফেরিতে একদা আনন্দ আত্মরক্ষার জন্য অনামিকাকে ফেলে পালিয়েছিলো। বহুদিন পর একই যাত্রাপথে ফেরি কুশায়ায় ঢাকা পড়লে তাদের গন্তব্য অনিশ্চিত হয়ে পড়লে আনন্দের অনুভবপুঞ্জ-‘‘শুধু আমরাই সচল হই না। একটি রজনী অতিক্রান্ত হয়ে গেছে আমরা এখানে উপবিষ্ট, দিবাভাগে কর্মচাঞ্চল্য শুরু হয়েছে, আমাদেরই কোনো চঞ্চলতা নেই, আমি আর অনা শুধু কুয়াশা অবলম্বন করে অপেক্ষা করছি আর অপেক্ষা করছি, কিন্তু কার বা কিসের; কিসের জন্য অপেক্ষামান তা আমি যেমন জানিনে তেমনি সম্ভবত অনারও অজ্ঞাত।’’ (পৃ. ৯৮) গল্পটির পরিণতিতে অতিপ্রাকৃত আবহ রয়েছে।

‘‘আজ অনামিকা’’ গল্পের এ্যান্টি-রোমান্টিক পরিণতি গল্পটিকে জনৈকা বিধবা নারীর ক্ষরণের অভিব্যক্তিতে প্রোজ্জ্বল করে তুলেছে। রং-নাম্বারে টেলিফোন করে কথক আলাপ চালাতো জনৈক নারীর সঙ্গে প্রতিদিন অফিস থেকে। কিন্তু শেষদিন আর উক্ত মহিলার কণ্ঠস্বর শোনা গেলো না। তার বদলে তাঁর কন্যা জানালো-‘‘একাত্তরে বাবা অফিসে গেলেন, আর এলেন না। দু’টোয় বাবার ছুটি হতো বলে মা দু’টো থেকে বাইরে ঘরে অপেক্ষা করে’’ (পৃ. ১০৯) সংবাদ। গল্পটির সংক্ষিপ্তীবোধ প্রশংসনীয়।

মূলত ‘‘উত্তরকাল’’ (১৯৮৭), ‘‘তখন’’ (৪৯৮৭), ‘‘পূর্বাপুর’’ (১৯৯৩) ব্যাপক অর্থে দেশীয় রাজনৈতিক সামাজিক-অর্থনৈতিক কথাবস্তুর রূপায়ণ। লেখকের গীতল বর্ণনা, বিবরণে বীভৎসতা পরিহার, শব্দে গ্রামীণ প্রেক্ষাপট বজায় রাখা এবং ছোটগল্পের সূক্ষ্ণ কারুকার্যের প্রতি মনোযোগ তাঁর ছোটগল্পগুলোকে আস্বাদিত করে তুলেছে। সমাজের সপ্তরঙা রূপাঙ্কনে রশীদ হায়দার রাজনীতি সচেতন। জীবনের নানাবিধ সঙ্কট, রাষ্ট্রে ও সমাজের মূল্যবোধের পরিবর্তন ও অবক্ষয় তাঁর লেখনীতে ধৃত হয়েছে। মূলত সামাজিক রাজনৈতিক জীবনে ১৯৭১-এর পর পরই নতুন একটি জোয়ার এসেছিলো। জনজীবনে মুক্তির একটি উল্লাস, কিন্তু অচিরকালের মধ্যে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর মানুষ ক্রমশ হতাশ ও আর্থ সামাজিক পীড়নের মধ্যে এসে পড়ে। চতুর্দিক এই অসুস্থ আবহের মধ্যে কিশোর তরুণেরা একটি উৎক্ষিপ্ত অবস্থায় ঘূর্ণিত হতে থাকে। এই সময়ের তরুণদের গল্পে কালের স্বাক্ষরই ক্রমাগত মুদ্রিত হয়েছে। রশীদ হায়দার এই তরুণদের সঙ্গে সংযুক্ত হয়েছেন। তাঁর গল্পে এজন্য আধুনিক শিল্পকলার পরিচর্যা লক্ষণীয়। যেমন- ‘‘চাঁদ ততক্ষণে মধ্য আকাশে। পিঠের আরো খানিকটা খাওয়া। সন্ধ্যার পরে এই ঢিবিতে ওঠার আগে আকাশে দেখেছে কোনো মেঘ নেই, এখন এখানে-সেখানে ছোপ ছোপ মেঘ চাঁদের কাছাকাছি, মেঘটায় ঘোলাটে হলদেটে রেখায় বাসেতের মনে হয় চাঁদের আরো কাছে গেলে এটা ঠিক গলে পড়বে। আকাশের আলো আঁধারী দেখতে দেখতে যতদূর চোখ যায়, চোখে পড়ে কি পড়ে না বড় বড় ঘাসেরা বাতাসে দুলছে, অদূরের গ্রামটাই একেবারে নেই, এমনকি কিছুদূরে মাঠের মধ্যে বিশাল বটগাছটা একটা স্থবির কালো পিন্ডছাড়া আর কিছুই নয়, বেশ ভয় ভয় করে বাসেতের।’’ … (উত্তরকাল, পৃ. ৪৩)

৭.

সকলকে বেদনাবিদ্ধ করে রশীদ হায়দার প্রয়াত হয়েছেন সত্য। কিন্তু তাঁর সৃজনশীল কাজের মধ্যে আমরা তাঁকে সবসময় খুঁজে পাবো। কেবল কথাসাহিত্য নয় তিনি মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে যে ব্যতিক্রমধর্মী গবেষণা ধারার সূচনা করে গেছেন তা নতুন প্রজন্মকে প্রকৃত ইতিহাস অন্বেষণে পথ দেখাবে।তিনি স্মরণীয় হয়ে থাকবেন আমাদের স্মৃতিতে এবং পৃথিবীর আলোময় ভুবনে মানুষের কথাকার হিসেবে।

সহায়ক গ্রন্থ :
১. একুশের প্রবন্ধ ’৮৮, বাংলা একাডেমি, ঢাকা।
২. ইদানিং, এযুগের প্রকাশনা, ১৯৮৫, ঢাকা।
৩. রশীদ হায়দার, ‘‘নানকুর বোধি’’, ১৯৬৭, ঢাকা।
৪. রশীদ হায়দার, ‘‘অন্তরে ভিন্ন পুরুষ’’, ১৩৮০, ঢাকা।
৫. রশীদ হায়দার, ‘‘মেঘেদের ঘরবাড়ি’’, ১৯৮২, ঢাকা।
৬. রশীদ হায়দার, ‘‘তখন’’, ১৯৮৭, ঢাকা।
৭. রশীদ হায়দার, ‘‘পূর্বাপর’’, ১৯৯৩, ঢাকা।
৮. রশীদ হায়দার, ‘‘উত্তরকাল’’, ১৯৮৭, ঢাকা।

লেখক : বিশিষ্ট লেখক, কবি, কলামিস্ট; সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রগতিশীল কলামিস্ট ফোরাম; নির্বাহী কমিটির সদস্য, সম্প্রীতি বাংলাদেশ এবং অধ্যাপক, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।