Main Menu

যে বিরক্ত হতে চায় না ‘ঘুঘু’ তার পড়ার দরকার নাই

রওশন আরা মুক্তা একাধারে কবি, গল্পকার ও শিশুসাহিত্যিক। পেশায় গণমাধ্যমকর্মী। এবার বইমেলায় মেধাবী এ লেখকের একটি ছোটগল্পের বই বের হয়েছে। বইটির নাম, ‘ঘুঘু’। প্রকাশ করেছে প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান ‘বৈভব’। আজ বিকেলেই (বুধবার) বইটি বইমেলার এসেছে। ‘ঘুঘু’ এবং সাহিত্য-টাহিত্য নিয়ে তার সঙ্গে গপসপ জুড়েছেন কবি ও কথাসাহিত্যিক আবু তাহের সরফরাজ।

আবু তাহের সরফরাজ: ‘ঘুঘু’ বইটাতে মোট ক’টা গল্প রয়েছে?
রওশন আরা মুক্তা: পাঁচটা গল্প আছে। বইটা হচ্ছে চার ফর্মার। প্রকাশক বৈভব। বইমেলার ৪২২ নং স্টল।

আবু তাহের সরফরাজ: গল্পগুলোর বিষয়ে ছোট্ট করে একটু ধারণা দেবেন কি?
রওশন আরা মুক্তা: গল্পগুলোর চরিত্রগুলো ক্যাওটিক। এটা অবশ্য আমার কথা না, আমার একজন বন্ধুর কথা, যিনি গল্পগুলো কমবেশি পড়েছেন। গল্পগুলোতে বর্তমান সময়ের নানা প্রসঙ্গই পাওয়া যাবে আসলে, সে কারণে চরিত্রগুলোও এই সময়ের মতোই অস্থির।

আবু তাহের সরফরাজ: এই সময়ের সব চরিত্রই কি ক্যাওটিক?
রওশন আরা মুক্তা: আমরা যা দেখি ও শুনি তা রিয়ালিটির খুব অল্প অংশ, তাই না? একটা মানুষের মনের পর্দায় ক্ষণে ক্ষণে নতুন নতুন চিন্তা আসে। প্রক্রিয়াটাই এমন যে, সে যে-কোনো একটাকে বেছে নেয় অটোমেটিক্যালি এবং ভাষায় তা প্রকাশ করে। কিন্তু অপ্রকাশিত হাজার হাজার লাখ লাখ চিন্তা মানুষের থাকে। সেটা মানুষের ভিতরেই থাকে, তা প্রকাশ হয় না। ধরেন, আপনি গাছের নিচে বসে আছেন, কিন্তু আসলে আপনি গাছের নিচে নাই, চলে গেছেন গত দুপুরে, হয়তো আপনি বাসের ভিতরে কাউকে দেখে চমকে গিয়েছিলেন সেই সময়ে অবস্থান করছেন; গাছের নিচে বসেই। যাকে দেখে চমকেছিলেন সে আপনার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকের মতো দেখতে, আপনি গাছের নিচে বসেই চলে গেছেন আপনার সেই প্রাথমিক বিদ্যালয়ে, এরপর সেখান থেকে বাড়ি ফিরে মায়ের বাড়া ভাত খেলেন। আবার ফিরে এলেন আজকের সকালেই, দু’দিন ধরে আপনি ভাত খান না। আপনার খিদা নাই, অসুখ। ডাক্তার দেখানো নিয়ে বিরক্ত হলেন গাছের নিচে বসে। বাইরে আপনি কি করলেন? চা বিক্রেতাকে ডেকে চা খেলেন, জরুরি ফোনকল করলেন, বাদাম খেলেন। তো এই টাইম ট্র্যাভেলিং মন কিছুটা তো ক্যাওটিকই। অন্যের সামনে ভদ্র হয়ে থাকে! ঘুঘুর গল্পগুলোতে চরিত্রগুলোর ভাবাভাবির বর্ণনা পড়তে পড়তে এ ব্যাপারটা বোঝা যাবে।

আবু তাহের সরফরাজ: ঘুঘুর প্রকাশিত দুটি গল্প আমি পড়েছি, মদ জিনিসটা প্রকট গল্প দুইটায়। এর কারণ কী?
রওশন আরা মুক্তা: আসলে মদের হাত থেকে তো আমাদের মুক্তি নাই। আমাদের সবাই কমবেশি কোনো না কোনো মদে ডুবে আছি, তাই না? আপনি মদকে জিনিস হিসাবেই পড়ছেন, কিন্তু সাহিত্যে লেখা যেকোনো কিছুই আসলে বস্তু দিয়ে ব্যাখ্যা করলে তার অর্থ খণ্ডিত হয়। মদ স্রেফ একটা শব্দ, এর অর্থ নানা কিছুই হতে পারে। সলিমুল্লাহ খান একটা বক্তৃতায় বলছিলেন, মোবাইলে কথা বলাও এক প্রকারের মদ। কথাটা আমার মনে ধরে খুব। সত্যিই তো। অতিরিক্ত যেকোনো কিছুই মদ পর্যায়ের ব্যাপার। মাতাল কখনই মদের লিমিটে থাকতে পারে না; আমরা তো জাতিগতভাবেই লিমিট ছাড়া, এটা বুঝতে এক মানিক মিয়া এভিনিউয়ের দিকে তাকালেই বোঝা যায়, বেশি দূর যাইতে হয় না।

আবু তাহের সরফরাজ: গল্প লেখার অভিজ্ঞতাটা কেমন? আপনি তো কবি হিসাবেই পরিচিত বেশি।
রওশন আরা মুক্তা: আমার তিনটা প্রকাশিত কবিতার বই, অপ্রাপ্তবয়স্কা, এলদোরাদো ও কেন দোলনচাঁপা। ‘পিতরি প্রীতিমাপন্নে’ নামে আরেকটা কবিতার বইয়ের পাণ্ডুলিপি আছে, সেটা প্রকাশ হবে আশা করি এই বছরই। আর কবিতা তো লিখছিই। ছোটদের জন্য ছড়া, গল্প লিখছি আগামী বইমেলা মাথায় রেখে। গত বইমেলায় আমার প্রথম গল্পের বই ‘টরে-টক্কা’ প্রকাশিত হয়। গল্প লেখা নিয়ে মজার একটা ঘটনা আছে, আমার গল্পগুলো আমি শেষ করতে পারতাম না। আমার লেখালেখির শুরু দুই হাজার পাঁচ সালে। তখন আমি গল্প শুরু করতাম কিন্তু গল্পগুলো দেখা যেত সামাজিক সমস্যা-সমাধাণ টাইপ হয়ে যেত, তাই সেগুলো ফেলে রাখতাম। দুই হাজার এগারোতে যখন একটা বিরতির পর আবার লেখালেখি শুরু করি তখন ইন্টারনেটের সুবাদে আমাদের সময়ের অনেক লেখকের সাথেই পরিচয় হয়। দুই হাজার বারোতে তানিম কবির একটা সাহিত্য পাতা দেখার দায়িত্ব পান, আমিও সেই সময় একটা অনলাইন সাহিত্য পাতার দায়িত্বে ছিলাম। তানিম একবার আমার গল্প চাইলেন। বললেন, আপনার গদ্য ভালো, গল্প লিখে দেন একটা। তানিমকে আমার সমস্যার কথা বলি, যে গল্পগুলো নীতিকথা হয়ে যাচ্ছে। তিনি বলেন, গল্পের নীতিকথা হয়ে যাওয়া সমস্যাটা নিয়ে একটা গল্প লিখতে। তানিমকে ধন্যবাদ এই উস্কানির জন্যে। আমি গল্পটা লিখি, টরে-টক্কায় যা ‘গল্পের নীতিকথা হয়ে যাওয়া সংক্রান্ত সমস্যা’ নামে প্রকাশিত। টরে-টক্কায় প্রকাশিত আটটি গল্প প্রায় পাঁচ বছর ধরে লেখা। আর ঘুঘুর পাঁচটা গল্প লিখেছি গত তিন বছরে। আশার কথা হলো, গল্পগুলো নীতিকথা হলো কিনা এই নিয়ে আমার এখন কোনো প্যারা নাই!

আবু তাহের সরফরাজ: বইয়ের নাম ‘ঘুঘু’ কেন?
রওশন আরা মুক্তা: হাহাহা! কেন দোলনচাঁপা, কেন ঘুঘু! ঘুঘুটা আসলেই কেন? আমরা সবাই একটা একটা ঘুঘু পালি মনের ভিতরে। যে ঘুঘু দৃষ্টি পড়লে ডিম ভেঙে দিয়ে বাড়িঘরসহ পালিয়ে যায়। তারে ধরা তো দূর, দেখাও যায় না! তবে সে ডাক দেয়, শুনতে চাইলে কান পাততে পারেন, কই জানি একটা ঘুঘু ডাকে সব সময়, মন দিলেই শুনতে পাওয়া যায়। তাকালেই হারিয়ে যায়। আমার গল্পের টাইম ট্রাভেলার চরিত্রগুলো এই ঘুঘু স্বভাবের। তারা ঘুঘুর মতো ডাকাডাকি করে, সকাল ও সন্ধ্যায় খাদ্যের জন্য নড়াচড়া করে আর সারাদিন বসে থাকে গাছের ডালে। বিরক্ত না করলে আদর দিয়ে ডিম ফোটায় বাচ্চা পালে। বিরক্ত করলেই উড়াল!

আবু তাহের সরফরাজ: কবিতা যখন লেখেন আর গল্প যখন লেখেন, বেশি আরাম পান কখন?
রওশন আরা মুক্তা: কবিতা লিখি টোটালি ঘোরের ভিতর, যেকোনো নেশামুক্ত অবস্থায় সব কিছু থেকে নিজেকে মুক্ত করে। আটকা থাকলে কবিতা লিখতে পারি না। আর বিষয়টা আমার জন্য আর আরামদায়ক নাই। বহু যন্ত্রণা! গল্প লেখাও কষ্টকর, পরিশ্রমের ব্যাপার। লিখে শেষ করে একটা তৃপ্তি কাজ করে; যা আরামের চেয়ে কয়েক কোটি গুণ আনন্দের।

আবু তাহের সরফরাজ: ঘুঘু বইয়ের গল্পগুলো লিখে আপনার প্রাপ্তিটা কি শুধু এই তৃপ্তিটুকুই? নাকি এর অন্য কোনো ভূমিকা আছে?
রওশন আরা মুক্তা: অবশ্যই আছে, লেখা প্রকাশ হয়ে যাওয়ার পর তা আর লেখকের বিষয় থাকে না। তা সবার হয়ে যায়। আমি গল্পগুলো দিয়ে মূলত মানুষকে বিরক্ত করতে চাই। অস্থির করে দিতে চাই। ঘুঘুর গল্প পড়ে কারও মন ভালো হলে বুঝতে হবে, গল্পগুলো সঠিকভাবে কাজ করে নাই। এই গল্পগুলো বিনোদন দেয়ার জন্য না শুধুই, বিরক্ত হওয়ার জন্য। যে বিরক্ত হতে চায় না তার এই বই পড়ার দরকার নাই।

আবু তাহের সরফরাজ: বিরক্ত করতে চান কেন?
রওশন আরা মুক্তা: এমন একটা অস্থির সময়ে কেউ কেন এত আরামে থাকবে? এত আরামের তো কিছু নাই। ময়লার ভাগাড়ে বসে পোলাও-কোর্মা খাওয়াটা কোনো বিলাসিতাও না, একটা অসুস্থতা। এইটা ভক্ষণরত মানুষদের মনে করিয়ে দিতে চাই, এবং নিজেও বিরক্ত থাকতে চাই।

সৌজন্যে – ছাড়পত্র