Main Menu

না ফেরার দেশে সিলেটের দুখু মিয়া খ্যাত ম আনফর আলী : কিছু স্মৃতি কিছু কথা

নব্বইর দশকের প্রথম দিক। সিলেট এম সি কলেজের তৃতীয় ছাত্রাবাসের আমি তখন আবাসিক ছাত্র। সিলেট সিটি হওয়াতো দূরের কথা বিভাগও তখন হয়নি। শহর বলতে আমরা জিন্দাবাজার আর বন্দর বাজার এলাকাটাকেই বুঝতাম।
সিলেটে কবি ,সাহিত্যিক আর সাংবাদিকদের তিনটি বড় আড্ডাস্থল ছিলো। প্রথমটি কেন্দ্রিয় মুসলিম সাহিত্য সংসদ ,দ্বিতীয়টি কবি দিলওয়ারের ভার্ত্যখলাস্থ বাসা আর তৃতীয়টি হচ্ছে বন্দরবাজারের কুদরত উল্লাহ সুপার মার্কেট।
তৃতীয়টিতে তেমন একটা যাওয়া আসা না হলেও প্রথম ও দ্বিতয়টিতে প্রায়ই যাওয়া আসা করতাম।
প্রতি বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় দরগা গেইটস্থ কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদে আড্ডা বসতো। ওখানে আমাদের মধ্যমনি হয়ে আসতেন সিলেটের বরেণ্য রাজনীতিবিদ ও সাবেক মন্ত্রী দেওয়ান ফরিদ গাজী।
আমার বন্ধু ও সহপাঠী বর্তমানে একটি কলেজের ভাইস প্রিন্সিপাল ও দৈনিক জালালাবাদ পত্রিকার সাহিত্য সম্পাদক নাজমুল আনসারীর নিয়মিত যাতায়াত ছিলো ওই আড্ডায়। আমাকেও মাঝে মধ্যে নিয়ে যেতো। এম সি কলেজ বাংলা বিভাগের তৎকালীন অধ্যাপক পরবর্তীতে বিভাগীয় প্রধান সৈয়দ মুজিবুর রহমানের ভাতৃষ্পুত্র সৈয়দ ফয়েজও অনেক সময় আমাদের সঙ্গী হতো।
কোন এক আড্ডায় ফয়েজ কিংবা নাজমুল আমার সাথে পরিচয় করিয়ে দেয় ম আনফর আলীর। ওই সময়ে সিলেটের মাঠে ময়দানের সাংবাদিক বলতে আমরা মুক্তাসিবুন নুন ,আ ফ ম সাঈদ ,সাইয়্যিদ চৌধুরী ,ইসহাক কাজল আর ম আনফর আলীকেই জানতাম।
আমি বেশ পূর্ব থেকেই ম আনফর আলীর ‘দুখু মিয়ার খোলা চিঠির ভক্ত ছিলাম। সিলেটের প্রায় পত্র পত্রিকায় কলামটি প্রকাশিত হতো।
১৯৯১ সালে আ ফ ম সাঈদ সম্পাদিত সিলেট সংবাদ কমলগঞ্জের উপর এক বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করে। এতে সাংবাদিক ইসহাক কাজলের বদান্যতায় আমারও একটি লেখা ছাপা হয়। আনফর ভাই আমার এই লেখাটি পড়েছেন বলে জানান।ভূয়সী প্রশংসা করেন। সুর’পত্রিকায় আমার কবিতা পড়েছেন সেটিও জানিয়ে দেন। সেই থেকেই আনফর আলী ভাইয়ের সাথে আমার সম্পর্ক।
১৯৯৪/৯৫সালের দিকে সিলেট অঞ্চলের বই প্রকাশিত হয়েছে এমন পঞ্চাশজন কবি সাহিত্যিকের ফটো সম্বলিত জীবনী প্রকাশ করে কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদ। ঘটনাক্রমে লেটার প্রেসের যুগে ১৯৯১ সালে আমার একটি কবিতার বই প্রকাশ পায় সেই সুবাদে এই পঞ্চাশ জনের মধ্যে আমার নামটিও ঢুকিয়ে দেন ম আনফর আলী ভাই।
এক সময় ছাত্র জীবন শেষ হয় কর্ম জীবনে প্রবেশ করি। ২০০৩সালের প্রথম দিকে বিলেত পাড়ি দেই ।ম আনফর আলী ভাইয়ের সাথে আর দেখা হয়নি।
২০০১৩/১৪ সালের দিকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেইসবুক আবারো সম্পর্ক সৃষ্টি করে দেয় আনফর আলী সাহেবের সাথে।
মাঝেমধ্যে ফোনে কথা হতো। ফেইসবুকে দেওয়া আমার প্রতিটি লেখা তিনি মনোযোগ দিয়ে পড়তেন আর সুন্দর সুন্দর মন্তব্য করতেন।
কোন কারণবশত মন্তব্য করতে না পারলে ইনবক্সে এসে পরবর্তীতে দুঃখ প্রকাশ করতেন।
২০১৫ সালে এসে তিনি ফেইসবুকে এক অভিনব সংবর্ধনার আয়োজন করেন। অনলাইনে এই ধরনের আন্তর্জাতিক সংবর্ধনা এর আগে কেউ করেছে কি না আমি জানি না।
২০০১৫ সাল থেকে ২০০১৯ সাল পর্যন্ত বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা তাঁর পরিচিত অসংখ্য বাঙালীদের তিনি সংবর্ধিত করেছেন। ২০১৬ সালে হঠাৎ আমাকে জানান তিনি আমাকে সংবর্ধিত করবেন। আমি অনেক অনুনয় বিনয় করে নিষেধ করি কিন্তু তিনি নাছোড় বান্দা। অবস্থা বেগতিক দেখে আমি তাঁর একান্ত ঘনিষ্ট ম্যানচেষ্টার এর কবি লিয়াকত ভাইয়ের স্বরনাপন্ন হই। আনফর ভাই খুব মনোকষ্ট পান এবং আমাকে জানিয়ে দেন সংবর্ধনা না নিলে তিনি আমার সাথে আর কোন সম্পর্কই রাখবেন না। শেষ পর্যন্ত নিতান্ত বাধ্য হয়ে আমাকে সংবর্ধনা নিতে হয়। ২০১৬ সালে তিনি আমিসহ তাঁর ১০০জন ফেইসবুক বন্ধুদের জীবনী সম্বলিত একটি বই বের করেন।
২০০১৭ সালে আমি স্বল্প সময়ের জন্য দেশে যাই। আমি যে দিন দেশে পৌঁছবো তিনি তাঁর কাহিনী অব্যক্ত’ বইটির প্রকাশনা উৎসব ওই দিন নির্ধারণ করেন। আমাকে অনুরোধ করেন এয়ারপোর্ট থেকে সরাসরি উৎসব স্থলে যাবার জন্য। সিলেটের তৎকালীন মেয়র বদর উদ্দিন কামরানসহ সিলেটের সকল বিশিষ্ট মানুষরা তাঁর প্রকাশনা উৎসবে যোগ দেন।দুঃখের বিষয় ফ্লাইট দেরী হওয়া জনিত কারনে আমি ওই উৎসবে যোগ দিতে পারিনি।
পরবর্তী সপ্তাহে সিলেট গেলে তিনি প্রচন্ড বন্যার মধ্যেও আমার সাথে দেখা করতে তাঁর গ্রামের বাড়ি মৌলভীবাজারের রাজনগর থেকে সিলেট শহরে চলে আসেন। এই সময়ে কুদরত উল্লাহ মার্কেটস্থ তাঁর অফিসটাও ছিলো জলে ডুবা।
কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদে আমার জন্য সংবর্ধনার আয়োজনে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়েন। আমি খুবই বিরক্ত হয়ে তাঁকে জানাই চার সপ্তাহের জন্য দেশে এসেছি এক সপ্তাহ চলে গেছে আপনি যদি এই ধরনের কিছু করার উদ্যোগ নেন আমি দুই সপ্তাহ সময় কমিয়ে আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে লন্ডন চলে যাব। পরক্ষণে তিনি নিভৃত হন।
তবে বিমুগ্ধ হই তাঁর আন্তরিকতা দেখে।
কাহিনী অব্যক্ত বইটি পড়ে বিস্মিত ও বিমর্ষ হই এই সদা হাসি খুশি মানুষটা কতটুকু কষ্ট বুকে চেপে রেখেছে। ফেইসবুকের মাঝে মধ্যে দুই চার লাইন লিখলেও ব্যক্তিগতভাবে তিনি কাউকে তাঁর কষ্টের কথা শোনাননি।
আশির দশকের প্রথমভাগ থেকে মানুষ ও সমাজের কষ্টের কথা দুঃখের কথা খোলাচিঠির মাধ্যমে প্রকাশ করলেও নিজের কষ্টের কথা অনেক বছর পাথর চাপা দিয়ে রেখেছেন।
২০১৯ সালে প্রায় দুইশত বন্ধুদের নিয়ে ছড়া লিখেছেন।
মাস পাঁচেক আগে আমি হঠাৎ চিন্তা করলাম এই মানুষটি শত শত মানুষকে নিয়ে লিখে তাঁকে নিয়েতো কেউ কিছু লিখে না।
রাতারাতি তাঁর একটি জীবন বৃত্তান্ত লিখে ফেললাম। ইনবক্সে লেখাটি পাঠালে তিনি বাকরুদ্ধ হয়ে যান ,চোখের পানিতে তাঁর ফোন ভিজে যায়। আমাকে পরবর্তীতে তিনি জানিয়েছেন,লেখাটি পড়ে তিনি এতো বেশি আবেগ আপ্লুত হয়ে পড়েন যে ,এক ঘন্টা কথাই বলতে পারেননি।
সেপ্টেম্বর /অক্টোবর ২০১৯ এর দিকে তিনি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন।
তাঁর চিকিৎসার্থে বন্ধু বান্ধবদের অনেকেই ব্যক্তিগত ভাবে এগিয়ে আসেন।
আমি ও আরও অনেকেই সম্মিলিত ভাবে এই মানুষটির জন্য কিছু করা যায় কিনা সে ব্যাপারে লেখালেখি শুরু করি।
বিলেতের বাঙালী কমিউনিটির প্রবীণ মুরব্বি আমাদের সর্বজন শ্রদ্ধেয় যুক্তরাজ্য বাংলা প্রেসক্লাবের সভাপতি বিশিষ্ট সাংবাদিক কে এম আবু তাহের চৌধুরী সিংকাপনীর সাথেও এ ব্যাপারে আমার যোগাযোগ হয়।
জানুয়ারীর প্রথম দিকে সিলেটের বিশিষ্ট ছড়াকার কবি ইমতিয়াজ সুলতান ইমরান ফোন করে আমাকে জানান আনফর ভাইয়ের অবস্থা খুবই আশঙ্কা জনক। আমি ইমতিয়াজ ভাইকে বলি আনফর ভাইয়ের মাধ্যমে তাহের ভাইয়ের সাথে যোগাযোগ করার জন্য।
পরবর্তীতে আনফর ভাই ও তাহের ভাইয়ের মধ্যে যোগাযোগ হয় এবং যতটুকু জেনেছি তাহের ভাই বড় ধরনের একটি উদ্যোগের দিকেই এগিয়ে যাচ্ছিলেন কিন্তু বিধি বাম হয়ে দাঁড়ায়।
শনি বার সকালে একটু বেশি ঘুমাই। বরাবরের মতো ১৮ জানুয়ারি শনিবার সকাল নয়টায় ঘুম ভাঙে। ফেইসবুক খুলতেই দেখি আনফর ভাইয়ের মৃত্যুর খবর। বিশ্বাস হচ্ছিলো না। মনে হচ্ছিলো এখনো বোধ হয় ঘুমিয়েই আছি।
ফোন করলাম ম্যানচেষ্টারের কবি লিয়াকত ভাই কে। তিনি নিশ্চিত করলেন ,আনফর ভাই আর জীবিত নেই।
মনের অজান্তেই চোখের জল গড়িয়ে পড়তে লাগলো।
মনে মনে ভাবলাম আর বললাম ,আনফর ভাইর সাথে আর দেখা হবে না,কথাও হবে না কখনও। মনে অনেক কষ্ট আর চাপা দুঃখ নিয়ে পরপারে পা রাখলেন সিলেটের দুখু মিয়া।
বিশ্বাস আছে আবারও দেখা হবে ,অন্য এক জগতে অন্য সময়ে। যেখানেই থাকুন ভালো থাকুন আনফর ভাই। আল্লাহ যেনো আপনাকে সব সময় ভালো রাখে।