Main Menu

তসলিমা নাসরিন: একটি প্রেমের মৃত্যু

ডালিম-বাগানের একটি নাম দিয়েছে আলিয়া, ডালিয়া। সেই থেকে আব্দুর রহমান বাগানটিকে ডালিয়া নামেই ডাকেন। আলিয়া নাম দিয়েছে বাগানের, সে নামে তো তিনি ডাকবেনই। তিন সন্তানের মধ্যে আলিয়াই তাঁর সবচেয়ে প্রিয়। নামকরণের এক সপ্তাহ পরই আরঘান্দাবে তার ডালিম- বাগানে ঢোকার মুখে ডালিয়া লেখা কাঠের একটি নামফলক বসিয়ে দিয়েছেন আব্দুর রহমান।

মায়ের মৃত্যুর পর সংসার দেখাশোনার ভার আলিয়ার ওপর। বড় দুই ভাইয়ের একজন কাবুলে, আরেকজন আমেরিকায়। ইউসুফ কাবুলে ডাক্তারি পড়েছে, কাবুলেই সরকারি হাসপাতালে চাকরি করছে। হামিদ কান্দাহার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে হোটেল ম্যানেজমেন্টে ডিগ্রি নিয়েই আমেরিকায় পাড়ি দিয়েছে। আমেরিকায় যে আত্মীয়রা থাকে, তারাই ভিসা পাওয়ার ব্যবস্থা করেছে। আলিয়ার কখনও কান্দাহার থেকে দূরে কোথাও যাওয়ার ইচ্ছে নেই। কাবুলের ভাইটি বছরে দু’তিনবার আসেন কান্দাহারে। আমেরিকারটির আসারই ফুরসত হয় না। তাঁর আফগান খাবারের দোকান আছে ক্যালিফোর্নিয়া্র ফ্রেমোন্টে। দীর্ঘদিন অনুপস্থিত থাকলে কর্মচারিরা ব্যবসা লাটে ওঠাবে, এরকম একটি আশংকা থেকেই তিনি দেশে আসতে চান না। গত পাঁচ বছর একবার মাত্র বেড়িয়ে গেছেন এক মেমসাহেবকে নিয়ে। মেমসাহেবের সঙ্গে বিয়ে হয়নি, কিন্তু হবে। বিয়ে হয়নি বলে আব্দুর রহমান ছেলেকে বাড়িতে ঢুকতে দেবেন না, বা দু’জনকে একঘরে শুতে দেবেন না, এমন কোনও নিষেধাজ্ঞা জারি করেননি। বিয়ে করার সময় হলেই ছেলে বিয়ে করবে। সে কান্দাহারে হোক বা ক্যালিফোর্নিয়ায় হোক। আমেরিকায় কী আর আফগানিস্তানের নিয়ম চলবে! যে দেশে বাস করছে, সে দেশের সংস্কৃতিতে যা করা দোষের নয়, সে তা করছে। এই ছিল আব্দুর রহমানের যুক্তি। এই যুক্তি আলিয়াও মেনে নিয়েছে। শুধু গজগজ করেছে আনসার। আনসারের তখন বয়স সবে আঠারো। আঠারো বছর বয়সেই তার আমূল পরিবর্তন ঘটে গেছে। ইস্কুল ছেড়ে বখাটে কিছু বন্ধুর পরামর্শে মাদ্রাসায় ঢুকেছে। কোরান মুখস্ত করে ফেলেছে। ঘর থেকে তার প্রিয় গায়কদের পোস্টার ছিঁড়ে ফেলে দিয়েছে। ঘরের দেয়ালে শুধু হাদিস কোরানের বাণী টাঙিয়ে রেখেছে। দাড়ি গোঁফ গজিয়েছে, সেগুলো ছেটে ফেলতে কোনও সেলুনে যাচ্ছে না, আব্দুর রহমান আর আলিয়া বার বার বলার পরও। হাসি উবে গেছে আনসারের। যতক্ষণ বাড়িতে থাকে, বিরক্ত চোখ, বিরক্ত মুখ, আর অস্থির পায়চারি।

দু’একজন পরিচিতজন আব্দুর রহমানকে জানিয়েছেন, আনসারকে তালিবানরা তুলে নিয়ে গেছে, শুধু একা আনসারকে নয়, মাদ্রাসার আরও কয়েকজন ছাত্রকেও। তারা মাদ্রাসায় পড়বে, কিন্তু তালিবানদের ট্রেনিং ক্যাম্পে থাকবে। আব্দুর রহমান প্রমাদ গোণেন। ছেলেকে মাদ্রাসা থেকে ছাড়িয়ে ইকরাম প্রাইভেট হাই স্কুলে ফের ভর্তি করাতে চেয়েছেন, কিন্তু আনসার নাছোড়বান্দা, সে মাদ্রাসা ছাড়বে না। ধরে বেঁধে টেনে হিঁচড়েও তালিবানদের ক্যাম্প থেকেও তাকে বের করা যায়নি। ইকরাম প্রাইভেট হাই ইস্কুলে আনসারের আর সব ভাই বোনেরা পড়েছে, কিন্তু আনসার পড়তে চায়নি, সে মাদ্রাসায় পড়বে, সে তালিবান হবে, সে আল্লাহর পথে যাবে।

দুই পুত্র কান্দাহার ছাড়ায় আব্দুর রহমান চোখের জল ফেলেন না। তিনি চান ইউসুফও যদি আমেরিকায় চলে যেতে পারে, ভালো হয়। তবে কাবুলের যে মেয়েটির সঙ্গে তার দীর্ঘদিনের সম্পর্ক, তাকে বিয়ে করেই যেন সে সস্ত্রীক আমেরিকায় পাড়ি দেয়। এটি ছাড়া ইউসুফের কাছে আব্দুর রহমানের আর কোনও চাওয়া নেই। তিনি তাঁর দু’পুত্রের কারও কাছ থেকে কোনও টাকা পয়সা চান না। তাঁর ডালিয়াই তাঁকে যথেষ্ট দেয়। তাঁর ডালিয়া পুত্র কন্যাকে প্রাইভেট ইস্কুলে পড়িয়েছে, কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়িয়েছে। ডালিয়ার ডালিম শুধু কান্দাহারের বাজারে নয়, পাকিস্তানে আর ভারতেও বিক্রি হয়। গত তিরিশ বছর ধরে বিক্রি হচ্ছে। লোক আছে রফতানির ব্যবসা চালানোর। রফতানির জন্য শুধু ডালিম নয়, শুকনো ফিগ, এপ্রিকট, আর আলমন্ড বাদামও কয়েক বছর দিচ্ছেন। এতে টাকা-পয়সা আগের চেয়ে ভালো আসছে। ভালো আসছে বলে ডালিয়ার বাগান আরও কয়েক একর বড় করেছেন। আলিয়ার জন্য একটি ফ্ল্যাট কিনেছেন। আলিয়া কান্দাহার বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস নিয়ে পড়তো। তালিবান ক্ষমতায় এসে যখন ঘোষণা করল মেয়েদের ইস্কুল কলেজে আর যাওয়া চলবে না, তখন থেকে আলিয়ার পড়া বন্ধ হয়ে গেল। আব্দুর রহমান শক্ত লোক, খাঁটি পাঠান। তারপরও তিনি মুখ ফুটে কিছু বলতে পারেন না, যখন দেখেন পাড়ার অল্প বয়সী ছেলে যাদের ন্যাংটো খেলতে দেখেছেন মাঠে, তারা কাঁধে বন্দুক নিয়ে ঘোরে আর হাসিস খায়, আর এর ওর বাড়িতে ঢুকে অত্যাচার করে। এসব কীর্তিকলাপের প্রতিবাদ করলে তিনি যে এই বাচ্চা ছেলেদের হাতে মার খাবেন জানেন। বাজারে লোকেরা এমনিতেই বলাবলি করে আব্দুর রহমান ধর্ম মানেন না, আমেরিকান হয়ে গেছেন। না, তিনি আমেরিকান হয়ে যাননি। তিনি গর্ব করেই আফগান পোশাক পরেন। তিনি মাথা উঁচু করেই তাঁর মাতৃভাষা পাষ্টুন বলেন। তিনি নামাজ রোজা করেননা ঠিকই, কিন্তু পরবে অনুষ্ঠানে, ঈদে শবেবরাতে জামাতে সামিল হতে আপত্তি করেন না। অন্য আফগানদের মতো ধর্ম পালন না করলেও সৃষ্টিকর্তা আছেন বলে বিশ্বাস করেন। তিনি বিশ্বাস করেন অপরাধীদের শাস্তি একদিন না একদিন হবেই। এই পৃথিবীতেই সেটি হবে। আলিয়া অবশ্য মানে না এটি। আলিয়া মনে করে অপরাধীরা বেশি আরাম আয়েশে থাকে দুনিয়ায়। সৎ এবং নিরীহ মানুষেরা ভোগে। আলিয়ার সঙ্গে সন্ধ্যের পর আব্দুর রহমানের নানা দর্শন নিয়ে দীর্ঘ আলাপ আলোচনা চলে। ঘরে আর কে আছে আলিয়া ছাড়া! আনসার বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে। একদিক দিয়ে ভালোই। উৎপাত কমেছে। তবে প্রায়ই সে ঢুঁ দেয় বাড়িতে। একবার এসে আলিয়াকে শাসিয়ে গেল আর একটি নীল বোরখা দিয়ে গেল। বোরখায় আপাদমস্তক না ঢেলে আলিয়া যেন রাস্তায় বের না হয়। আগুন ঠিকরে বেরোচ্ছিল আনসারের দুচোখ থেকে। এই আনসারকে আলিয়া আর চিনতে পারে না। মা মারা যাওয়ার পর এই ছোট ভাইটিকে মায়ের অভাব অনুভব করতে দেয়নি। আলিয়াই মুখে তুলে খাওয়াতো, গল্প বলে বলে ঘুম পাড়াতো। সাধারণত আলিয়া বাইরে গেলে সালোয়ার কামিজ পরে মাথায় একটি ওড়না পরে। এই পোশাকেই সে বিশ্ববিদ্যালয়ে গেছে, বাজার হাট করেছে, অনুষ্ঠানাদিতে গেছে। কোনওদিন কোনও অসুবিধে হয়নি। অসুবিধে বাইরের লোকেরা যদি করতো, তাহলেও মন মানতো। অসুবিধে করছে ঘরের লোক। আরেকদিন এসে আব্দুর রহমানের সিন্দুকের তালা ভেঙে কয়েক লাখ আফগান আফগানি নিয়ে গেছে আনসার। আব্দুর রহমানকে আলিয়া বলেছিল পুলিশকে জানাতে।
আব্দুর রহমান জানাননি, বলেছেন, কী করে পুলিশে খবর দিই বল! নিজের ছেলে। ছেলে নষ্ট হয়ে গেছে। মাথা তো আমারই নত হবে।

আলিয়া বলেছেন, ছেলে বলে অপরাধীকে ক্ষমা করে দেবে?
ক্ষমা করছি না।এ তো বোঝাই যাচ্ছে যে সে এই টাকা তালিবানদের দিয়েছে। এখন পুলিশও তো তালিবানদের আদেশে চলে। আমাকেই না আবার কোনও একটা মিথ্যে মামলায় জেলে ভরে রাখে। দেশে তো কোনও আইন নেই, কার কাছে বিচার চাইবো?

আলিয়া নিজের চোখেই দেখছে কী করে বদলে গেল কান্দাহার, তার প্রিয় শহর। এই শহরে তার বাবা আব্দুর রহমান স্বধর্ম বিসর্জন না দিয়ে তাকে আগলে রেখেছেন। বিপত্নীক হয়েছেন বুড়ো হওয়ার আগেই, তবু পুত্র-কন্যাদের কথা ভেবে দ্বিতীয় বিয়ে করেননি। আলিয়ার তিন ভাই-ই ভিন্ন ভিন্ন কারণে বাড়ি ছেড়েছে। বাড়ি ছাড়ার ইচ্ছে আলিয়ার অন্তত নেই। তার বাবা একেবারেই একা পড়ে যাবে। এই যে ঘরে তিনি স্বস্তি শান্তি পান, সে আলিয়া আছে বলেই। বাড়িতে রান্না করে দেওয়ার লোক আছে, ঘর দোর সাফ করারও লোক আছে। ডালিম-বাগানের কর্মচারিদের স্ত্রী কন্যারাই আব্দুর রহমানের বাড়ির কাজকর্ম করে দেয়। কিন্তু আরাম আয়েশ আর খাওয়া দাওয়াই জীবনের সব নয়। যদিও আব্দুর রহমান দীর্ঘশ্বাস ফেলতে ফেলতে আলিয়াকে একদিন বলেছেন আলিয়ার হয়তো আমেরিকায় গিয়ে লেখাপড়াটা শেষ করা জরুরি। হ্যাঁ আমেরিকায় গিয়ে সে মাস্টার্স শেষ করবে, ডিগ্রি নেবে, চাকরি করবে, স্বাবলম্বি হবে, এ এমন কোনও কঠিন কাজ নয়। কঠিন কাজ আব্দুর রহমানকে ছেড়ে যাওয়া। যে মানুষটি স্ত্রীর মৃত্যুর পর একা রয়ে গেলেন সন্তানদের জন্য, একটি সন্তানও বৃদ্ধ বয়সে তার পাশে থাকবে না, এ আলিয়া মেনে নিতে পারে না। সে হেসে তার বাবাকে বলেছে, আমার লেখাপড়া নিয়ে এত ভেবো না বাপুজি, তালিবান গোষ্ঠী তো একদিন যাবে, তখন ইস্কুল কলেজ খুলবে, মেয়েরা তাদের অধিকার ফিরে পাবে, তখন না হয় লেখাপড়া শেষ করবো, ডিগ্রি নেবো, এত তাড়া কিসের! আমি তো শুধু একা ভুক্তভোগী নই, দেশের সব মেয়েই তো। তারাও তালিবানের শেষ দেখতে চাইছে। আসলে বাবাকে ফেলে আমেরিকায় চলে যাওয়ার ইচ্ছে আলিয়ার নেই। ইচ্ছে নেই ইমতিয়াজকে ছেড়ে যাওয়ার। ইচ্ছে নেই ইমতিয়াজকে বিয়ে করে দুবাই চলে যাওয়ারও। ইমতিয়াজের সঙ্গে তার সম্পর্কের বয়স প্রায় এক যুগ। এখনও তারা বিয়ে করছি, বিয়ে করবোতে ঝুলে আছে। আলিয়া একবার ভাবে বিয়েটা হয়তো হয়ে যাওয়াই ভালো। আবার ভাবে, কী দরকার ঝামেলা করার! বিয়ে সংসার সন্তান ইত্যাদি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে কী এমন বিরাট উপকার সে করবে নিজের!

আব্দুর রহমান ছেলে মেয়েকে উচ্চশিক্ষিত দেখতে চান যদিও নিজে তিনি কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে পারেননি। কিন্তু ফলের ব্যবসা করে সন্তানদের এমন শিক্ষিত করতে চেষ্টা করেছেন কাউকে যেন তাঁর মতো ফলের ব্যবসায় নামতে না হয়। সন্তানরা যেন ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার হয়, অধ্যাপক হয়, অথবা সম্মানজনক কোনও পেশা বেছে নেয়। বড় দুই পুত্র নিয়ে ভাবনা নেই। আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে না যেতে পারলেও ঘরে বসে বিস্তর পড়াশোনা করে। দেখলেও সুখ হয় আব্দুর রহমানের। কনিষ্ঠ পুত্র আনসারই শুধু তাঁকে অসম্মানের চূড়ান্ত করেছে, তাঁর গৌরব, তাঁর অহংকার মাটিতে মিশিয়ে দিয়েছে। আনসারের বিপথে যাওয়ার জন্যই তিনি প্রতিদিন দুঃখ করেন। তাঁর রক্তচাপ বাড়তে থাকে।

ইমতিয়াজের পরিবারের লোকেরা বছর দুই হলো দুবাই চলে গেছে। একা বড়িতে ইমতিয়াজই বাস করে। শহর ছাড়লে তাকে চাকরি ছাড়তে হবে। এই চাকরিটি সে আপাতত হারাতে চায় না। আলিয়াকে ছেড়েও দূরে চলে যাওয়ার ইচ্ছে তার নেই। তবে প্রতিদিন তালিবানরা যেভাবে হত্যাকাণ্ড চালাচ্ছে তা দেখে আলিয়াকে সে কয়েকদিন বলেছে, চল সব ছেড়ে ছুড়ে দুবাই চলে যাই। কান্দাহার এখন আর সেই কান্দাহার নেই। কী লাভ এই দমবন্ধ পরিবেশে বাস করে!
আলিয়া বলেছে, –যাবো ইমতিয়াজ নিশ্চয়ই যাব। কিন্তু বাবাকে ছেড়ে যেতে পারছি না আপাতত।
–তাকে দেখাশোনার তো লোক আছে।

–আছে, কিন্তু আমি যেভাবে দেখবো, সেভাবে কে দেখবে? গল্প তো আমার সঙ্গেই করেন। বন্ধু বান্ধবদের সঙ্গে সময় কাটাতে তাঁর আর ভালো লাগে না। সবাই নাকি এক এক করে তালিবান হয়ে যাচ্ছে।
ইমতিয়াজ বলে, — আমার পরিবারের যারা দুবাই চলে গেছে, তারা তালিবান হয়নি, কিন্তু ম্যাজিকের মতো কান্দাহারে যত পরিবারের লোকজন ছিল, সবাই মনে হয় এক রাত্তিরে তালিবানে যোগ দিয়েছে। এখন কান্দাহারে হাতে গোনা লোক পাবে, যারা তালিবানকে সমর্থন করছে না।
আলিয়ারও মনে হয় এমন।

আলিয়াকে এখন আনসারের দেওয়া নীল বোরখা পরেই বেরোতে হয়। এ ছাড়া উপায় নেই, বাজারে, বিশ্ববিদ্যালয়ে দু’জায়গাতেই বোরখা না পরার কারণে তাকে তালিবান নীতি- পুলিশদের চাবুকের মার খেতে হয়েছে। এমন মার যে ঘাড় পিঠ নিতম্ব উরু সব লাল হয়ে গিয়েছিল দাগে। যে মেয়েটি বাড়িতে রান্নার কাজ করে, সে মলম লাগিয়ে দিয়েছে কয়েকদিন। ধীরে ধীরে যন্ত্রণা কমেছে, কিন্তু দাগ রয়ে গেছে। এই দাগগুলো দেখতে দেখতে ইমতিয়াজ দীর্ঘশ্বাস ফেলেছে। বলেছে, দুবাই যেতে না চাও, আমাকে বিয়ে করতে না চাও, তো চলে যাও ক্যালিফোর্নিয়া ভাইয়ের কাছে। এই নরকে কেন থাকছো? তালিবানের সন্ত্রাস শেষ হলে বাপের কাছে ফিরে এসো। বাপ বাপ করে নিজের জীবনটাকে তুচ্ছ করছো আলিয়া।
আলিয়া জানে সে তা করছে। দুবাই গিয়ে ইমতিয়াজের সঙ্গে সুখের সংসার করতে পারে, অথবা ক্যালিফোর্নিয়ায় গিয়ে নিজে স্বাবলম্বী হতে পারে। দুটোই তার হাতের কাছে। কিন্তু কান্দাহারের মায়া সে ছাড়তে পারে না। বাবার প্রতি কর্তব্যও সে উড়িয়ে দিতে পারে না।

ইমতিয়াজ গার্ডিয়ান পত্রিকার আফগান প্রতিনিধি। সাংবাদিকতার ফাঁকে ফাঁকে সে ইংরেজিতে একটি ঐতিহাসিক উপন্যাস লিখছে। আলিয়ার যেহেতু ইতিহাসে অঢেল জ্ঞান, বইটি লিখতে তাকে সাহায্য করে আলিয়া। প্রেরণাও যথেষ্ট যোগায়। মাঝে মাঝে দিনের অনেকটা সময় আলিয়া ইমতিয়াজের সঙ্গেই কাটায়। প্যাঞ্জোয়েয় তাদের দুজনেরই বাড়ি। হেঁটেই যাওয়া আসা করে তারা। ইমতিয়াজও যায় আলিয়াদের বাড়ি। একা বাড়িতে খাওয়া দাওয়ার চাইতে আলিয়াদের বাড়িতেই রাতের খাওয়া অনেক সময় সেরে আসে। আব্দুর রহমান পছন্দ করেন ইমতিয়াজকে। আলিয়া আর ইমতিয়াজ দু’জনের বয়সই তিরিশের কাছে। দু’জনই প্রাপ্ত বয়স্ক। তাদের সঙ্গে যে কোনও বিষয় নিয়ে আব্দুর রহমান কথা বলতে পারেন। শুকনো ফলের রফতানি তিনি ছেড়ে দেবেন বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, এ কথা ইমতিয়াজকে জানান। ইমতিয়াজ ব্যবসা বাণিজ্যে উৎসাহী নয়, সে শুধু মাথা নেড়ে সায় দেয়। যে সিদ্ধান্তই নেন আব্দুর রহমান সবই নাকি খুব তুলনাহীন।

প্রায়ই ঝড়ো হাওয়ার মতো বাড়িতে ঢোকে আনসার। কাঁধে রাইফেল থাকে তার। একবার দুপুরবেলার দিকে বাড়িতে ঢুকে তার যে গিটার, বেহালা, এস্রাজ ছিল, ভেঙে টুকরো টুকরো করে দিয়ে গেছে। আরেকবার এসে ইমতিয়াজকে দেখে তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলো। অথচ এই ইমতিয়াজকে সে ছোটবেলা থেকেই চেনে পরিবারের ঘনিষ্ঠ লোক হিসেবে। ইমতিয়াজের বাবা ছিলেন আব্দুর রহমানের বন্ধু।
আনসার চিৎকার করে বলতে লাগলো, –আলিয়ার সাথে কী সম্পর্কে এই লোকের?
আলিয়া ধমকে বললো, –তুই জানিস না কী সম্পর্ক?
–না, আমি জানি না। আমাকে আজ জানতে হবে।
–তোকে জানতেই হবে কেন? বড়দের ব্যাপারে মাথা ঘামানোর দরকার নেই তোর।
আবারও চিৎকার করে বললো আনসার, মাথা আমাকে ঘামাতেই হবে। আমি এই লোককে আর এ বাড়িতে দেখতে চাই না।

–ইমতিয়াজের সঙ্গে আমার বিয়ে হবে, সে হবে তোর দুলাভাই। সুতরাং দুলাভাইকে সম্মান করে কথা বলতে শেখ।
–যে লোক ইসলামের রীতি নীতি মানে না, তাকে সম্মান করি না। বিয়ে হওয়ার পর সম্মানের প্রশ্ন উঠতে পারে, এখন নয়। এখন তুমিও পরপুরুষের সামনে আসতে পারবে না।
–মগজধোলাই হয়ে গেছে তোর। এইসব জঙ্গিপনা ছেড়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আয়।
–এটাই আমার স্বাভাবিক জীবন। তোমরা এখনও সাবধান হও। ইসলাম বর্জিত কাজকারবার চলছে এ বাড়িতে, আমি কিন্তু হেড কোয়ার্টারে কমপ্লেইন করবো। তখন কিন্তু অবস্থা ভয়ঙ্কর হবে।
এরপর সে আলিয়াকে ধাক্কা দিয়ে ‘পরপুরুষের সামনে আর এক মুহূর্ত নয়’ বলতে বলতে বৈঠক ঘরে থেকে বের করে। এমন জোরে জোরে ধাক্কা দেয় যে দেয়ালে কপাল লেগে কপাল কেটে যায় আলিয়ার। ইমতিয়াজ দৌড়ে গিয়ে আলিয়াকে পিঠ দিয়ে আড়াল করে। আব্দুর রহমান উঠে এসে টেনে সদর দরজার কাছে নিয়ে যান আনসারকে। বলে দেন– এ বাড়ির দরজা তোর জন্য বন্ধ। যদি ফিরে আসতে হয়, মানুষ হয়ে ফিরে আসিস, অমানুষ হয়ে নয়।

এর কিছুদিন পর আব্দুর রহমান দেখেন কান্দাহারের মোহমান্দ ফলের বাজারে সঙ্গে কোনও পুরুষ অভিভাবক নেই বলে বোরখা পরা মেয়েদের লাঠিপেটা করছে কিছু তালিবান, এর মধ্যে আনসারও আছে। দেখে মাথা নিচু করেন লজ্জায়। তিনি আনসারের সামনে সটান দাঁডিয়ে বলেন, এসব বর্বরতা থামা বলছি।

ঘৃণার দৃষ্টি ছুঁড়ে দেয় পুত্র তার পিতার দিকে। যেন লোকটি কে, সে চেনে না। আব্দুর রহমান এবার এক হাতে তার হাতের লাঠি কেড়ে নেয়, আরেক হাতে তাকে টেনে গাড়ির দিকে নিয়ে যেতে থাকে। হাত ছাড়িয়ে নেয় আনসার, লাঠিও কেড়ে নেয়। ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয় নিজের জন্মদাতাকে। এই আনসারকে আব্দুর রহমান চিনতে পারেন না। তাঁর কষ্ট হয় ভাবতে এই ছেলে তাঁর ছেলে। তাঁর আশঙ্কা হয়, আনসারকে আরও জোর করলে সে তার বাবাকেই হয়তো পেটাবে, বাবার পিঠেই হয়তো চাবুক চালাবে।
দ্রুত বাড়ি ফিরে তিনি আলিয়াকে বলেন ক্যালিফোর্নিয়ায় ফোন করতে। হামিদের কাছে এর আগে কোনও কিছু চান নি আবদুর রহমান, আজ চাইলেন। আজ বললেন, –বাবা হামিদ, তোমাকে এই কাজটি করতেই হবে, তুমি তোমার ছোটভাই আনসারকে তোমার কাছে নিয়ে যাও। পরিবারের জন্য এই কাজটি করো। ছেলে উচ্ছন্নে গেছে, এখন একে বাঁচাতে হলে, একে আফগানিস্তান থেকে দূরে, সম্পূর্ণ ভিন্ন পরিবেশে, নিয়ে যেতে হবে। এছাড়া উপায় নেই। এই ছেলে ত্রাস করে বেড়াচ্ছে, বাড়িতে, বাড়ির বাইরে।
হামিদ বলেন তিনি চেষ্টা করবেন, তবে নিয়ে যাও বললেই তো নিয়ে যাওয়া যায় না। হয়তো আনসার আসতে চাইবে না। যদি আসতে চায় তাহলেও অন্তত কয়েক মাস তো লাগবেই কাগজপত্র পাঠাতে।

আনসারের কারণে ইমতিয়াজ আলিয়ার বাড়িতে আসা বন্ধ করে দিয়েছে। কিন্তু দেখা তাদের ঠিকই হয়। ইমতিয়াজের বাড়িতেই হয় দেখা। কিন্তু একসময় ইমতিয়াজের সন্দেহ হয় এখানেও এসে তাণ্ডব করতে পারে আনসার। তাই দেখা কিছুটা কমিয়ে ফোনে কথা হতে থাকে দু’জনের। আগে দু’জন কান্দাহার জাদুঘরে যেত, বাবরের বাগানে যেত, দুররানির মাজারে যেত, পার্কে যেত, আইনো মেনায় আব্দুর রহমান যে ফ্ল্যাট কিনে রেখেছেন আলিয়ার জন্য, সেখানেও যেত। কিন্তু পায়ে শেকল এখন। অবিবাহিত নারী পুরুষকে মেলামেশা করতে দেখলে সর্বনাশ করবে ভেবেই ঘরবন্দি হয়ে আছে দু’জন।

ঘরবন্দি জীবন খুব স্বাভাবিক কারণেই দু’জনের কারওরই পছন্দ নয়। বিয়েটা এবার সেরে ফেলতেই পরিবারের সঙ্গে পাকা কথাবার্তা বলে ফেলে ইমতিয়াজ। তবে সে জানে সবার আগে আলিয়ার সম্মতির প্রয়োজন। বেশ কিছুদিন থেকেই সে আলিয়ার মুখোমুখি বসতে চাইছে। আলিয়াও অনেকদিন বসছি বসবো করছে। তবে ফোনেই আলিয়া ইমতিয়াজকে স্মরণ করিয়ে দেয় যে বিয়ে তো একা একা হয়ে যাবে না, বিয়ে জিনিসটা সামাজিকতা ছাড়া কিছুই নয়। দুবাই থেকে ইমতিয়াজের আত্মীয়দের আসতে হবে কান্দাহারে, ক্যালিফোর্নিয়া থেকে আলিয়ার আত্মীয় স্বজনকে আসতে হবে। বিয়েতে সঙ্গীত আর নৃত্যের যে উৎসব চায় আলিয় আর ইমতিয়াজ, তা তালিবানের আমলে সম্ভব নয়। তালিবান কোনও সঙ্গীতের আওয়াজ বরদাস্ত করবে না, কোনও ঘুঙুরের শব্দ সহ্য করবে না।

প্রায় চারমাস ঘরবন্দি থেকে অস্থির হয়ে ওঠে আলিয়াও। একদিন ইমতিয়াজকে তার বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে নিজেই গাড়ি চালিয়ে আরঘান্দাব যায় । রাস্তার এক ধারে পাহাড়, আরেক ধারে আরঘান্দাব নদী। অনেকদিন তালিবানের ভয়ে তার দম বন্ধ হয়ে আসছিল। অনেকদিন ইমতিয়াজকে না দেখে শরীর মন বড় তৃষ্ণার্ত হয়ে উঠেছিল। নির্জন এলাকা আরঘান্দাব, এখানেই তাদের ডালিমের বাগান ডালিয়া। ইমতিয়াজ আগে এখানে দু’বার এসেছে, আলিয়া অবশ্য প্রায়ই আসে। ডালিমের চাষ দেখতে, গাছ থেকে ডালিম পেড়ে শত শত কর্মচারিরা যখন ডালিম বাক্সে ভরে, সেই চমৎকার দৃশ্য দেখতে। এই সময়টা না ডালিম পাকার সময়, না বাক্সে ভরার সময়। নির্জনতা আর নৈঃশব্দের নদীতে ডুবে আছে চারদিক। ডালিয়ার যে ঘরটি আব্দুর রহমানের বিশ্রামের জন্য, সেটি গোছানো, শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত। সারাদিনের খাবার যা সে বাড়ি থেকে নিয়ে এসেছে, ফ্রিজে রেখে দেয়। মাইক্রওয়েভে নেই, কিন্তু উনুন আছে। সময় হলে গরম করে খেয়ে নেবে। ইস্পাতের আলমারি থেকে বিছানার চাদর বালিশ বের করে বিছানায় বিছিয়ে দেয়। লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ে দু’জনই। সারাদিনের জন্য ডালিম-বাগানে হারিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনাটি আলিয়াই করেছে। ইমতিয়াজেরও আজ ব্যস্ততা নেই। শারীরিক সম্পর্কটি তাদের নতুন নয়। দু’ আড়াই বছরের সম্পর্ক এটি। নীল বোরখাটি খুলে ফেললে, সালোয়ার কামিজ আর অন্তর্বাস খুলে ফেললে আলিয়া এক অনিন্দ্য সুন্দরী যুবতী। ঘন কালো ভুরু, ঘন কালো দীর্ঘ কেশ, কালো হরিণাক্ষি, গোলাপি গায়ের রঙ, পুরু ঠোঁট, সুগোল স্তন, ক্ষীণ কটি, মাংসল নিতম্ব, লম্বা লোমহীন দীর্ঘ উরু, পা, পায়ের আঙুল। যেন শরীর নয়, এ এক ধারালো তরবারি। ইমতিয়াজ অপলক চোখে দেখে আলিয়াকে। এত দেখেছে, তারপরও তৃষ্ণা মেটে না। বিছানায় আলুথালু শুয়ে থাকা আলিয়াকে আলতো করে স্পর্শ করে ইমতিয়াজ। শরীর জুড়ে চিত্র আঁকে আঙুল, যেন আঙুল নয়, তুলি। বিচিত্র আর অদৃশ্য সব দৃশ্য আঁকা হয়ে যেতে থাকে। ইমতিয়াজের আঙুলের এই স্পর্শ আলিয়ার ক্লান্তি ঝেড়ে ফেলতে থাকে, কুড়ি থেকে আলিয়া পদ্মের মতো ফুটে ওঠে। ইমতিয়াজের লোমশ বুকে মিশে যেতে থাকে সে। সুদর্শন পাঠান যুবকের গালে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। এই দাড়ির ঘর্ষণ মুখে বুকে লেগে অনন্ত বর্ষণ ঘটাতে থাকে। ভেজা চুম্বনে উষ্ণ হতে থাকে দুটো শরীর। মৈথুনে পার হয় তাদের গোটা দুপুর। যখন ক্ষিধে পায় দু’জনের, ইমতিয়াজই উঠে বিছানায় খাবার নিয়ে আসে। এখানে বসেই খাবে। কাপড় চোপড় পরার ঝামেলায় কেউ যায় না। দরজা জানালা সব বন্ধ। কেউ উঁকি দিয়ে দেখার নেই। ঘরে কেন, তারা ডালিম-বাগানে উলঙ্গ হেঁটে এলেও কেউ দেখবে না। নান, মাংসের কোফতা আর কাবাব, কাবেলি পুলাও, আশাক, সুজির হালুয়া। খাওয়ার সময়ই দরজা প্রচন্ড ধাক্কার শব্দ, উঠে দরজা খোলার সময় দেয়না, দরজা ভেঙে ঘরে ঢোকে এক দল তালিবান। হুড়মুড়িয়ে উঠে কাপড় চোপড় পরতে নেয় দুজন, তার আগেই উলঙ্গ দুজনকে ঘর থেকে টেনে বের করে আনে দশ বারোজন তালিবান। সকলের হাতে অস্ত্র। তালিবানদের মধ্যে আলিয়া আর ইমতিয়াজ দু’জনই দেখে, আনসারকে। একজন নীল বোরখাটি ঘর থেকে এনে ছুঁড়ে দেয় আলিয়ার শরীরের ওপর। আলিয়া দ্রুত বোরখাটি গায়ে গলিয়ে গা ঢাকে। ওদিকে ওরা দড়ি দিয়ে ইমতিয়াজের হাত পা শক্ত করে বেঁধে ফেলেছে।

–আনসার, ছেড়ে দে আমাদের, এদের নিয়ে চলে যা তুই, যথেষ্ট বীরত্ব দেখিয়েছিস, এবার থাম। আলিয়া চেঁচিয়ে বলে।
আনসার উত্তর দেয় না, উল্টে পাষ্টুন ভাষায় যত কুৎসিত গালি আছে বিরতিহীন ছুঁড়তে থাকে আলিয়ার উদ্দেশে।
আলিয়াকে স্টেডিয়ামে নিয়ে পুরো কান্দাহারের লোক জড়ো করে পাথর ছুঁড়ে হত্যা করা হবে, এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সিদ্ধান্তটি নেয় দলের নেতাগোছের একটি।

আলিয়া বোরখার ঢাকনা সরিয়ে আনসারকে আবারও বলতে থাকে, ‘’আনসার, লক্ষ্মী ভাইটি আমার, ওদের পাল্লায় পড়িস না, ওদের বল আমাদের ছেড়ে দিতে। তুই বললে ওরা শুনবে। ইমতিয়াজের সঙ্গে আমার বিয়ে হবে খুব তাড়াতাড়ি, আমরা কোনও পাপ করছি না। আমি তোকে কোলে কাঁখে রেখে বড় করেছি, কী করে সব ভুলে গেছিস আনসার!’
আনসার চেঁচিয়ে বলতে থাকে–তুই পাপিষ্ঠা, এই আল্লাহর দুনিয়ায় বেঁচে থাকার কোনও অধিকার তোর নেই।
ওদিকে ইমতিয়াজ আনসার ছাড়াও আর দু’জনকে চিনতে পারে। ওদের নাম ধরে ডেকে ডেকে বলে যে, ওরা যেন এক্ষুনি কাজি ডেকে তাদের বিয়ের ব্যবস্থা করে। বিয়েটা হয়ে গেলে তারা যেন তাদের মুক্তি দেয়। কে কাকে মুক্তি দেবে! মুক্তি দেওয়ার বদলে ইমতিয়াজকে চাবুক দিয়ে বেধড়ক পেটায় দুটো তালিবান। মুখ খুললে আর মুক্তি চাইলেই চাবুক। কোনও উপদেশ দিতে চাইলেই চাবুক। শুধু মুখ বুজে মাথা নিচু করে বসে থাকতে হবে। বসে বসে চোখের জল ফেলতে হবে।

ইমতিয়াজ আর আলিয়া অসহায়ের মতো পড়ে থাকে, কিন্তু চোখের জল ফেলে না। এক একটি মুহূর্তকে তাদের মনে হয় এক একটি নারকীয় যুগ। আনসার এই তালিবানগুলোকে এখানে নিয়ে এসেছে বোনকে হেনস্থা করতে, ভাবতেই গা গুলিয়ে ওঠে আলিয়ার! চেনা ছেলেগুলো তাদের ঘিরে রেখে বেয়নেটে খোঁচাচ্ছে, দাঁত কেলিয়ে হাসছে, থুতু ছিটোচ্ছে, দেখে মনে হয় এক পাল হায়েনা হল্লা করছে। যেন তাদের এখন ছিঁড়ে খাবে তারা। ইমতিয়াজ বিশ্বাস করতে পারছে না, আনসার, আলিয়ারই আপন ছোট ভাই এই হায়েনার দলের একজন।

দলের দশ জন বলে কাল আলিয়াকে জনসমক্ষে পাথর ছুঁড়ে হত্যা করা হবে, আর ইমতিয়াজকে একশ’ চাবুক মারা হবে। কিন্তু দু’জন বলে আগামীকাল পর্যন্ত অপেক্ষা না করে এক্ষুনি এই ব্যাভিচারিনীকে মেরে ফেলা উচিত, ব্যাভিচারিনীর শাস্তি আল্লাহতায়ালাই বলেছেন মৃত্যুদণ্ড। দু’জনের মধ্যে একজন আনসার।

তালিবানরা নিজেদের মধ্যে যখন বাক বিতণ্ডা করছিল, হঠাৎ কোত্থেকে বিশাল একটি পাথর নিয়ে এসে আলিয়ার মাথা লক্ষ্য করে ছোঁড়ে আনসার, আবারও পাথরটি উঁচু করে মাথাটা মুহুর্মুহু থেতলাতে থাকে আনসার। ইমতিয়াজ দড়ি ছিঁড়ে বেরোতে চায় আলিয়াকে বাঁচাতে, পারে না। আলিয়ার আর্তচিৎকার হাওয়ায় ভাসতে থাকে। নীল বোরখাটি হেলে পড়ে, ধীরে ধীরে লাল হতে থাকে বোরখাটি। ডালিয়ার মাটিও তখন ডালিমের রঙের মতো লাল।